কালেমার বিবরণ এবং কালেমা সমূহ (৭টি)
কালেমা কি?
কালেমা বা কালিমা (আরবি: ٱلكَلِمَات) ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস সংবলিত কয়েকটি আরবি পংক্তির নাম। এর মাধ্যমেই ইসলামের প্রথম স্তম্ভ শাহাদাহ্ পূর্ণতা পায়। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ — আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ বা উপাস্য নেই। এটি ইসলামের চূড়ান্ত কালেমা।
আমাদের দেশে ইসলামী ঈমান-আকীদার বিবরণের ক্ষেত্রে ‘পাঁচটি কালিমা’( ১.কালিমা-ই-তায়্যিবা,২.কালিমা-ই শাহাদত,৩.কালিমা-ই-তাওহীদ,৪.কালিমা-ই-তামজীদ,৫.কালিম-ই-রদ্দে কুফর)এবং ঈমানে মুজমাল ও ঈমানে মুফাসসাল নামে দুটি ঈমানের কথা প্রচলিত আছে।
কালেমা সমূহ
১। কালিমা-ই-তায়্যিবা (পবিত্র বাক্য)
لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللَّٰهِ
উচ্চারণ :- লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।
অর্থ ঃ- আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত ইবাদত-বন্দেগীর উপযুক্ত আর কেই নেই। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বর ।
আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষের কর্মের পুরস্কার অথবা শাস্তির মানদণ্ড হচ্ছে এই কালিমা। এটির প্রচারের জন্য আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। এক কথায় মুসলিম জাতিসত্তার ভিত্তি হলো এই কালিমাটি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার পূর্বে যে রাসুলই পাঠিয়েছি তার প্রতি ওহী দিয়েছি যে, আমি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। কাজেই তোমরা আমারই বন্দেগি করো।’ (সুরা আম্বিয়া-২৫) হজরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রহ.) বলেন, মানুষের ওপর আল্লাহতায়ালার বড় নিয়ামত হলো তিনি তাদেরকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাথে পরিচয় করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে পিপাসাকাতর ব্যক্তির জন্য ঠান্ডা পানি যেমন প্রয়োজন তেমনি জান্নাতবাসীর জন্য এই কালিমা প্রয়োজন। যে ব্যক্তি এই কালিমাকে স্বীকৃতি দান করল সে তার সম্পদ এবং জীবনের নিরাপত্তা গ্রহণ করল। আর যে তা অস্বীকার করল সে তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ করল না। (ইবনে রজব, কালিমাতুল ইখলাছ : ৫২-৫৩)
এই পবিত্র বাক্যটিকে ইসলামের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এটি পাঠ করা ছাড়া কেউ মুমিন দাবি করতে পারবে না। এমনকি এটি স্বীকার করা ছাড়া যত আমলই করুক না কেন সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। বাক্যটি পাঠ করার মাধ্যমে মানুষের চিন্তা-চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। কোনো ব্যক্তি সারাজীবন শিরক ও কুফরিতে লিপ্ত থেকে জীবনের শেষ সময়ে এসে যদি বাক্যটি মনেপ্রাণে পাঠ করে তা হলে সেও আল্লাহর কাছে মুক্তি ও সফলতা লাভের যোগ্য হয়ে যায়।
কালিমা তায়্যিবার ফলে ঈমানের সম্পদ অর্জিত হয়। তার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত হয় এবং আল্লাহর প্রেরীত রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ভলোবাসা ও অনুগত্য প্রদর্শনের মনোভাব তৈরি হয়। সারা জীবন মুমিন বান্দা পবিত্র বাক্যের আলোকে জীবন পরিচালনা করে তাহলে এর ফসল কবরে হাশরেও লাভ করবে।
কালিমা তায়্যিবাহর দাবি ঃ কালিমা তায়্যিবাতে বিশ্বাসীদের কিছু অত্যাবশ্যকীয় দাবি পূরণ করতে হয়।
২। কালিমা-ই- শাহাদত (সাক্ষ্য বাক্য)
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ وأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
উচ্চারণঃ– আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু ।
অর্থঃ-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই । তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই ।আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর শ্রেষ্ঠ বান্দা এবং তাঁর প্রেরিত রাসুল।
ইসলাম ডেস্ক-কালেমায়ে শাহাদাত হচ্ছে, ঈমানের মৌলিক দুটি বিষয় তথা তাওহিদ এবং রিসালাতের ঘোষণাকে সুদৃঢ় করার জন্য সাক্ষ্য দেওয়ার ভাষায় ব্যক্ত করা। এটি ঈমান এবং ইসলামের দ্বিতীয় প্রধান কালেমা হিসেবে গণ্য।
মহান আল্লাহ তায়ালা হলেন পরম সত্য বা মহাসত্য। এই সত্যের সাক্ষ্যই হলো ইমান বা ইমানের দাবি। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয় নবী আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন মহাসত্যবাদী ও পরম বিশ্বাসী বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তাঁর সত্য নবুয়ত ও রিসালাতের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও নিঃশর্ত সাক্ষ্য প্রদান ইমানেরই অংশ। তাঁর প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা হলো ইমান। তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ হলো ইসলাম।
৩। কালিমা-ই তাওহীদ (একত্ববাদ বাক্য)
তাওহিদ (আরবি: توحيد) ইসলাম ধর্মে এক আল্লাহর ধারণাকে বোঝায়।তাওহিদ শব্দের অর্থ একত্ববাদ ইসলামি পরিভাষায় তাওহিদ হল সৃষ্টি ও পরিচালনায় আল্লাহকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে বিশ্বাস করা, সকল ইবাদাত-উপাসনা কেবলমাত্র আল্লাহর জন্য করা, অন্য সবকিছুর উপাসনা ত্যাগ করা, আল্লাহর সুন্দর নামসমূহ ও সুউচ্চ গুণাবলীকে তার জন্য সাব্যস্ত করা এবং দোষ ত্রুটি থেকে আল্লাহকে পবিত্র ও মুক্ত ঘোষণা করা।
আরবি
لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ ٱلْمُلْكُ وَلَهُ ٱلْحَمْدُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ حَيٌّ لَا يَمُوتُ أَبَدًا أَبَدًا، ذُو ٱلْجَلَالِ وَٱلْإِكْرَامِ بِيَدِهِ ٱلْخَيْرُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণ :- লা-ইলাহা ইল্লা আনতা ওয়াহিদাল্লা-ছা-নীয়া লাকা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহি ঈমামুল মুত্তাকীনা রাসূলু রাব্বিল আলামীন ।
অর্থ :- আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তিনি একক, এবং তাঁর কোন অংশীদার নেই। মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল, ধর্মভীরুদের নেতা, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের রাসূল।
ফজরের নামাজ কয় রাকাত? নিয়ম ও সময়
৪ । কালিমা-ই- তামজীদ (গুণ বাক্য)
আরবি
سُبْحَانَ ٱللَّٰهِ وَٱلْحَمْدُ لِلَّٰهِ وَلَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ وَٱللَّٰهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِٱللَّٰهِ ٱلْعَلِيِّ ٱلْعَظِيمِ
উচ্চারণ ঃ- লা-ইলা-হা ইল্লা আনতা নুইরাই ইয়াহুদিয়াল্লাহু লিনুরিহী মাইয়াশা-উ মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহে ইমামুল মুরছালীনা ওয়া খা-তামুন নাবিয়্যীন ।
অর্থঃ– হে আল্লাহ তুমি ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তুমি আলোময় যাকে ইচ্ছা আপন আলোর দিকে পথ প্রদর্শন কর। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল। তিনি পয়গম্বরগণের ইমাম ও সর্বশেষ নবী।
৫। ঈমানে মুজমালঃ-
ইমান মানে বিশ্বাস, মুজমাল অর্থ সংক্ষিপ্ত বা সারমর্ম, সারাংশ, সারবস্তু, মর্মকথা। ইমানে মুজমাল অর্থ হলো ইমান তথা বিশ্বাস এবং ইসলাম তথাআনুগত্যেরমোদ্দা কথা।ইমানে মুজমাল-এর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দুটি দিক রয়েছে। প্রথম অংশে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সত্তা ও অস্তিত্বে বিশ্বাসের ঘোষণা রয়েছে এবং বলা হয়েছে, ‘বিশ্বাস করলাম যেমন রয়েছেন তিনি স্বীয় সত্তায়, নামাবলি ও গুণাবলিসহ।’ কোরআন করিমে রয়েছে, ‘যে জন স্বর্গে ও পৃথিবীতে আছে সে–ই তাঁহার নিকটে প্রার্থনা করে, প্রতিদিন তিনি একাবস্থায় আছেন।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, রুকু: ২, আয়াত: ২৯, পারা: ২৭ পৃষ্ঠা: ৫৩৩/১১)।
امنت بالله كما هو باسمائه وصفاته وقبلت ميع احکامه واركانه *
উচ্চারনঃ-আ-মানতু বিল্লা-হি কামা হুয়া বি-আসমা-য়াহ ওয়া সিফাতিহী ওয়া কাবিলত জামী’ আ আকা মিহা ওয়া আরকা-নিহী।
অর্থ : আমি মহান আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম
যেরূপ তিনি আছেন তাঁর নাম ও গুণাবলীর সাথে এবং আমি তাঁর যাবতীয় আদেশ ও বিধানকে গ্রহণ করে নিলাম ।
৬। ঈমানে মুফাসসালঃ-
امنت بالله وملئكته وكتبه ورسله واليوم الاخر
والقدر خيره وشره من الله تعالى والبعث بعد الموت : *
উচ্চারণঃ- আ-মানতুবিল্লা-হি ওয়া মালা-ইকাতিহি ওয়া কুতুবিহি ওয়া রুসূলিহি ওয়াল ইয়াওমিল আ-খিরি ওয়াল কাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লা-হি তা’আলা ওয়াল বা-ছি বা’দাল মাওত
অর্থ ঃ- আমি আল্লাহ্ তা’আলা, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, নবী রসূলগণ, বিচার দিন ও তাক্বদীরের ভাল-মন্দ যে আল্লাহর পক্ষ হতে হয়ে তৎপ্রতি এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনয়ন করলাম।
ইমান অর্থ বিশ্বাস, মুফাসসাল অর্থ বিস্তৃত বা বিস্তারিত; ‘ইমানে মুফাসসাল মানে হলো ইমান ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ।
ইমানে মুফাসসালে অতী গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সাতটি বিষয় বিবৃত হয়েছে, যা প্রতিটি বিশ্বাসী মোমিন বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকার করবেন। এই সাতটি বিষয় যথাক্রমে: (১) আল্লাহ, (২) ফেরেশতা, (৩) কিতাব, (৪) রাসুল, (৫) কিয়ামত, (৬) তাকদির ও (৭) পরকাল।
অযুর দোয়া, নিয়ম, নিয়ত এবং অজু ভঙ্গের কারণ
৭। কালিমা-ই- রদ্দে কুফর (কুফরী-বর্জন বাক্য)
আরবি
ٱللَّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ شَيْءً وَأَنَا أَعْلَمُ بِهِ وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ بِهِ تُبْتُ عَنْهُ وَتَبَرَّأَتُ مِنَ ٱلْكُفْرِ وَٱلشِّرْكِ وَٱلْكِذْبِ وَٱلْغِيبَةِ وَٱلْبِدْعَةِ وَٱلنَّمِيمَةِ وَٱلْفَوَاحِشِ وَٱلْبُهْتَانِ وَٱلْمَعَاصِي كُلِّهَا وَأَسْلَمْتُ وَأَقُولُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ ٱللَّٰهِ
উচ্চারণঃ-আল্লা-হুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিন- আন উশরিকা বিকা শাইআও ওয়া ন’মিনু বিকা ওয়া আসতাগফিরুকা মাআ’লামু বিহী ওয়া মা-লা -আ’লামু বিহী ওয়া আতূবু মিন কুল্লি যানবিওঁ ওয়া আ-মানতু ওয়া আকূলু আললা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহি ।
অর্থ :- হে আল্লাহ! আমি তোমারই নিকট আশ্রয় চাচ্ছি তোমার সঙ্গে কাউকে শরীক করা থেকে। আমি তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি। আর আমার জানা এবং অজানা সকল প্রকার গুনাহ হতে তোমার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। আমি সকল প্রকার পাপ কাজ হতে তওবা করছি। আমি তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করছি এবং বলছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ।
মন্তব্য: কোন মুসলমানের ঈমান নষ্ট হলে পুনরায় ঈমান এনে উল্লিখিত কালেমা পাঠ করে তওবা করতে হবে।
আরও আর্টিকেল সমূহ-
- ইসলাম কাকে বলে ?
- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত, সময় এবং ফজিলত
- জানাজার নামাজের দোয়া, নিয়ম এবং নিয়ত
- রোজার নিয়ত, রোজা ভঙ্গের কারণ এবং রোজার ফজিলত