কিভাবে আলু চাষ করলে লাভবান হওয়া যাবে?
আজকে আমরা জানব আলু উৎপাদনের সঠিক নিয়ম ও কিভাবে আলু চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে বা কিভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব।
আলু হলো বাংলাদেশের একটি অন্যতম সবজি ফসল।আলুর হেক্টর প্রতি ফলন ধান ও গম অপেক্ষায় অনেক বেশি। প্রতি হেক্টর জমি থেকে একক সময়ে আমরা অনেক বেশি পরিমাণে ফলন পেতে পারি। শীতকালে আলু উৎপন্ন হয়। কার্তিক -অগ্রহায়ণ মাস মিলেই হেমন্তকাল। আলু কার্তিক মাসের শেষের দিকে আলু চাষের উপযোগী সময়।

আলু আগাম জাত (Early variety) হলে সেপ্টেম্বর – অক্টোবর মাসে আলুর বীজ বপন করতে হবে। মাঝারি জাত(Mid variety)হয় তাহলে অক্টোবর -নভেম্বর মাসে আর যদি নাভি জাতের ( Late varity)আলু হয় তাহলে নভেম্বর -ডিসেম্বর মাসে বীজ বপন করতে হবে।
আলু উৎপাদনের সঠিক তাপমাত্রা হলো ১৫-২০ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (centigrade)।
বীজ আলু উৎপাদন :
জমি নির্বাচন ও তৈরি : বীজ আলুর ভালো ফলন পাওয়ার জন্য সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ মাটি সর্বোত্তম। নিচু এলাকায় বর্ষার পানি নেমে গেলে বা উঁচু এলাকায় আশ্বিন মাস হতে আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতি কাজ শুরু করা হয় । এই মাটি চাষ করা মোটামুটি সহজ । আলুর জমি ৫-৬ বার চাষ ও বার কয়েক মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে জমি প্রস্তুত করা হয় । আজকাল পাওয়ার টিলার দ্বারা চাষ করা হয় বলে ৩-৪ বার আড়াআড়ি চাষ দিলেই ঝুরঝুরা হয় এবং সমান করা হয় । নির্বাচিত জমি অন্যান্য ফসল যেমন- মরিচ, টমেটো, তামাক ইত্যাদি সোলানেসি গোত্রভুক্ত ক্ষেত থেকে অন্তত ৩০ মিটার দূরে রাখতে হয় । চাষ অন্তত ১৫ সেমি গভীর হতে হবে। মাটি বেশি শুকনো হলে প্লাবন সেচ দিয়ে মাটিতে ‘জো’ আসার পর আলু লাগাতে হবে ।
বীজ শোধন : হিমাগারে রাখার আগে বীজ শোধন না হয়ে থাকলে অঙ্কুর গজানোর পূর্বে বীজ আলু বরিক এসিড দিয়ে শোধন করে নিতে হবে (১ লি. পানি + ৩০ গ্রাম বরিক পাউডার মিশিয়ে বীজ আলু ১৫-২০ মিনিট ডুবিয়ে পরে ছায়ায় শুকাতে হবে)।
বীজ প্রস্তুতি : বীজ আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে আস্ত আলু বপন করা ভালো, কারণ আস্ত বীজ রোপনের পর এগুলোর রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। আলু কেটে লাগালে প্রতি কর্তিত অংশে অন্তত ২ টি চোখ অবশ্যই রাখতে হবে আলু কাটার সময় বারবার সাবান পানি দ্বারা ছুরি বা বটি পরিষ্কার করা উচিত যাতে রোগ জীবাণু এক বীজ থেকে অন্য বীজে না ছড়ায় । বীজ আলু আড়াআড়িভাবে না কেটে লম্বালম্বিভাবে কাটতে হবে ।
মাটিতে ওষুধ প্রয়োগ : ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধের জন্য শেষ চাষের পূর্বে প্রতি শতাংশ জমিতে ৮০ গ্রাম স্টেবল ব্লিচিং পাউডার বা ক্লোরোপিক্সিন মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া উত্তম।
সার প্রয়োগ : দুটি কারণে আলুতে সুষম সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক । প্রথমত সুষম সার প্রয়োগ করলে আলুর উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদিত বীজ আলুর গুণগত মান ভালো হয়। দ্বিতীয়ত গাছে কোনো খাদ্যোৎপাদনের অভাবজনিত লক্ষণ সৃষ্টি হলে ভাইরাস রোগের উপস্থিতি নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশে আলু চাষের জন্য নিম্নলিখিত হারে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং সবটুকু গোবর, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, জিঙ্ক সালফেট, বরিক পাউডার জমিতে মিশিয়ে দিতে হয় । বাকি ইউরিয়া রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর গাছের গোড়ায় মাটি তুলে দেওয়ার সময় প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে ।
সারের নাম = প্রতি শতাংশে
পচা গোবর =৪০ কেজি
ইউরিয়া =১৪০০গ্রাম
টিএসপি =৯০০ গ্রাম
এমওপি =১০৬০গ্রাম
বরিক পাউডার/ বোরন সার=২৫ গ্রাম
জিঙ্কসালফেট =৫০ গ্রাম
জিপসাম =৫০০গ্রাম
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট= –
বীজ হার ও রোপণ সময় : বীজ হার নির্ভর করে রোপণ দূরত্ব ও বীজের আকারের উপর। সাধারণত প্রতি হেক্টরে ১.৫ থেকে ২ টন বীজ আলুর প্রয়োজন (একরে ৬০০-৮০০ কেজি)।
★লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব
#আস্ত আলুর ক্ষেত্রে =৬০সেমি।
#কাটা আলুর ক্ষেত্রে =৬০সেমি।
★বীজ থেকে বীজের দুরত্ব:
#আস্ত আলুর ক্ষেত্রে =২৫সেমি।
#কাটা আলুর ক্ষেত্রে = ১০-১৫ সেমি
সেচ ব্যবস্থাপনা: মাটির আর্দ্রতার উপর ভিত্তি করে ২-৪টি সেচ প্রদান করা উচিত। জমিতে পর্যাপ্ত রস না থাকলে বীজ আলুর অঙ্কুরোদগমের জন্য হালকা সেচ দেওয়া যেতে পারে, তবে সেচ বেশি হলে বীজ পচে যাবে। রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে সেচ দিতে হবে কারণ ৩০ দিনের মধ্যে স্টোলন বের হতে শুরু করে। সাধারণত কেইলের ২/৩ ভাগ পানি দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে।
*গম চাষ পদ্ধতি : জেনেনিন কিভাবে করবেন গম এর চাষ
আগাছা দমন:রোপনের পর থেকে ৬০ দিন পর্যন্ত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। সাধারণত গাছ ছোট থাকাকালীন অবস্থায় আগাছা যথাসম্ভব দমন করে রাখতে হবে।এছাড়াও বথুয়া জাতের আগাছা যা ভাইরাস রোগের বিকল্প বাহক হিসাবে কাজ করে তা অবশ্যই নির্মুল করে ফেলতে হবে।
মাটি উঠিয়ে দেওয়া: ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করে সেচ দেওয়ার পর মাটিতে ‘জো’ আসলে ভেলি বরাবর মাটি উঠিয়ে দিতে হবে। পরবর্তীকালে প্রয়োজনবোধে আরও একবার ভেলি বরাবর মাটি উঠিয়ে দিতে হবে যাতে আলু বাহিরে না যায় এবং স্টোলন ও আলুর ভিতর থাকে।
রগিং:চারা গজানোর পর থেকে রগিং শুরু করতে হবে। রোগাক্রান্ত গাছ শিকড়সহ উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
কিভাবে আলু চাষ করলে লাভবান হওয়া যাবে?
রোগবালাই ও পোকা দমন :
আলুর রোগঃ আলুর রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে মড়ক রোগ, ব্যাকটেরিয়া জনিত ঢলে পড়া রোগ,দাঁদ রোগ, কাণ্ড পচা রোগ,ভাইরাস জনিত রোগ অন্যতম।
নিম্ন তাপমাত্রা, কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া, মেঘলা আকাশ আলুর জন্য ক্ষতিকর।এতে আলুর মড়ক রোগ (লেইট ব্লাইট) আক্রমণ বেশি দেখা যায়। আলুর ফসল কে এ অবস্থা থেকে রক্ষা করার জন্য স্পর্শক (কণ্টাক্ট) জাতীয় ছত্রাকনাশক নিয়মনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।
কাটুই পোকাঃ এ পোকার কীড়া আলুর প্রধান ক্ষতিকর পোকা। এরা গাছ কেটে দেয় এবং আলু আক্রমণ করে।
*খুব সকালে যে সব গাছ কাটা পাওয়া যায় সেগুলোর গোড়া থেকে মাটি সরিয়ে পোকার কীড়া বের করে মেরে ফেলতে হবে।
*আক্রমণ তীব্র হলে অনুমোদিত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
জাব পোকাঃ জাব পোকা গাছের রস খায় এবং ভাইরাস রোগ ছড়ায়। বীজ আলু উৎপাদনের জন্য জাব পোকা দমন করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য গাছের পাতা গজানোর পর থেকে ৭-১০ দিন পর পর জাব পোকা দমনের জন্য অনুমোদিত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে। জাব পোকার আক্রমণ এড়াতে ৭০-৮০দিনের মধ্যে আলু সংগ্রহ করা উত্তম।
ফসল সংগ্রহ এবং পরিচর্যা : আধুনিক জাতে পরিপক্বতা আস্তে ৮৫-৯০ দিন সময় লাগে।তবে বীজ আলুতে সংগ্রহের অন্তত ১০ দিন সেচ দেওয়া বন্ধ রাখতে হবে।
হাম পুলিং: মাটির উপরের গাছের সম্পুর্ণ অংশকে উপড়ে ফেলাকে হাম পুলিং বলে। আলু সংগ্রহের ৭-১০দিন পূর্বে হাম পুলিং করতে হবে। এতে সম্পুর্ণ শিকড়সহ গাছ উপড়ে আসবে কিন্তু আলু মাটির নিচে থাকে যাবে। হাম পুলিং এর ফলে আলুর ত্বক শক্ত থাকে,রোগাক্রান্ত গাছ থেকে রোগ বিস্তার কম হগ ও আলুর সংরক্ষণগুন বৃদ্ধি পায়। বীজ আলুতে অবশ্যই হাম পুলিং করতে হবে।তবে খাওয়ার আলুর বেলায় হাম পুলিং জরুরি নয়।
আলু উত্তলন: আলু উত্তলনের পর পরই বাড়িতে আনতে হবে। আলু তোলার পর কোনো অবস্থাতেই ক্ষেতে স্তুপাকারে রাখা যাবে না, কারন আলু খোলা রাখলে তা বিভিন্ন প্রকার রোগ ও পোকা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে(যেমন -সুতলি পোকা ডিম পাড়তে পারে।)
আলু সংরক্ষণ :আলু উত্তলনের পর বাড়িতে এনে সাথে সাথে কাটা,দাগি ও পচা আলু আলাদা করতে হবে। তারপর ৭-১০দিন মেঝেতে আলু বিছিয়ে রাখতে হবে।অতঃপর আবারও দাগি,পচা আলু বেছে ফেলে দিয়ে ভালো আলু বস্তায় ভরে হিমাগারে পাঠাতে হবে।
গ্রামে অনেকেই বালুতে আলু রাখে। এভাবে রেখেও আলু অনেক দিন সংরক্ষণ করে ৫-৬ মাস আলু সংরক্ষণ করা যেতে পারে।তবে মাঝে মাঝে কোনো আলু পচে গেছে নাকি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং ২-৩ দিন পর পর চেক করা জরুরি।
এছাড়াও বীজ আলু উৎপাদনের আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে। যেমন-
(ক) ট্যিসু কালচার পদ্ধতি
(খ) স্প্রাউট ও টপ শুট কাটিং পদ্ধতি
(গ) বিনাচাষে বীজ আলু উৎপাদন
(ঘ) আলু প্রকৃত বীজ উৎপাদন
আরও জানুন