গোসলের দোয়া এবং ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব
গোসলের বিবরণঃ
গোসলের পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে শরীয়াতের নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী পবিত্রতা লাভের উদ্দেশ্যে পাক পানি দ্বারা সমস্ত শরীর উত্তমরূপে ধৌত করা।
কুরআনের বলা হয়েছে :যদি তোমরা অপবিত্র হও (সহবাস কর) তাহলে বিশেষভবে পবিত্রতা অর্জন করবেঅপবিত্র হও (অর্থাৎ স্ত্রী সহবাস কর) তাহলে বিশেষভাবে পবিত্রতা অর্জন করবে (অর্থাৎ গোসল করবে)। (সূরা মায়েদা : ৬) হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) চার কারণে গোসল করতেন। (১) নাপাকীর কারণে। (২) জুমআর দিনে। (৩) শিংগা নেওয়ার কারণে ও (৪) মৃত ব্যক্তিকে গোসলদানের কারণে। (আবু দাউদ)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে আবশ্যক সে যেন অন্তত প্রত্যেক সাত দিনের মধ্যে একদিন গোসল করে এবং তাতে সে তার মাথা ও শরীর ধৌত করে। (বুখারী ও মুসলিম)
গোসলের নিয়ত: গোসলের দোয়া
نويت الغسل لرفع الجنابة –
উচ্চারণঃ- নাওয়াইতুল্ গোস্লা লিরাইল জানাবাতি ।
অর্থ:আমি ‘জানাবাত’ হইতে পাক হওয়ার জন্য গোসল করিতেছি।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে শুরু করছি’ বলা।
অতঃপর অজুর মধ্যে বার বার এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আর তাহলো-
اَللّهُمَّ اغْفِرْلِىْ ذَنْبِىْ وَوَسِّعْ لِىْ فِىْ دَارِىْ وَبَارِكْ لِىْ فِىْ رِزْقِىْ
উচ্চারণঃ-‘আল্লাহুম্মাগফিরলি জামনি, ওয়া ওয়াসসি’লি ফি দারি, ওয়া বারিকলি ফি রিযক্বি।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার গোনাহগুলো ক্ষমা করে দিন এবং আমার জন্য আমার বাসস্থান প্রশস্ত করে দিন এবং আমার রিজিকে বরকত দিন।’ (নাসাঈ)
অজু ও গোসল করার পর আল্লাহর শোকরিয়া আদায় এবং দোয়া পড়া:-
اَشْهَدُ اَنْ لَا اِلهَ اِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ وَ اَشْهَدُ اَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ
اَللَّهُمَّ اجْعَلْنِىْ مِنَ التَّوَّابِيْنَ وَاجْعَلْنِىْ مِنَ الْمُتَطَهِّرِيْنَ
উচ্চারণঃ-আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আ’বদুহু ওয়া রাসুলুহু।
আল্লাহুম্মা-ঝআলনি মিনাত-তাওয়্যাবিনা ওয়াজআলনি মিনাল মুতাত্বাহহিরিন।
- অযুর দোয়া, নিয়ম, নিয়ত এবং অজু ভঙ্গের কারণ
গোসল করিবার সুন্নাত তরীকা:
গোসলের নিয়ত করে তারপর ‘বিসমিল্লাহ্’ পড়ে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুয়ে তারপর গুপ্তস্থান ধুবে। অতঃপর ওজু করবে। ওজুতে ভালভাব গড়গড়া করে কুলি করবে। রোজাদার হইলে শুধু কুলি করবে, গড়গড়া করবে না। তিনবার কুলি করা সুন্নত। তারপর তিনবার নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করবে। ওজুতে ঘাড় মাসেহ্ পর্যন্ত শেষ করে তখনকার মত পা ধোওয়া বাদ রাখিয়া, তারপর যথাক্রমে মাথায়, ডান কাঁধে ও বাম কাঁধে তিনবার এমনভাবে পানি ঢালবে, যাতে সারা শরীর ভিযে পানি গড়াইয়া পরে এবং উভয় পা ধোয়া হয়ে যায়।
গোসলের প্রকারভেদ:
গোসল সম্পর্কিত বিভিন্ন হাদীসের ব্যাখ্যায় ফিকাহশাস্ত্রবিদগণ গোসলকে চারভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন:
(১) ফরয গোসল ।
(২) ওয়াজিব গোসল
(৩)সুন্নত গোসল
(৪) মুক্তাহার গোসল
যে সব কারণে গোসল করা ফরয হয় সাতটি জিনিষের যে কোন একটি ঘটলে গোসল করা ফরয হয় না।
- শরীরের বাহ্যিক অংশের দিকে বীর্য বেরিয়ে আসা, যখন সহবাস ব্যতিত কাম ভাবসহ বীর্য নিজ স্থান হতে পৃথক হয়।
- স্ত্রী লিঙ্গে হাশফা পর্যন্ত প্রবিষ্ট হওয়া। হাশফার পরিমাণ হল পুরুষাঙ্গের চামড়া কর্তিত অংশ অর্থাৎ অগ্রভাগ।
- মৃত ব্যক্তি অথবা পশুর সাথে মিলন করে বীর্যপাত করা।
- নিদ্রা অবস্থায় শরীরে বা পোশাকে তরল পানি দেখতে পাওয়া। নিদ্রার পূর্বে পুরুষাঙ্গ যদি উত্তেজিত না থাকে।
- নেশাবস্থা বা অজ্ঞানাবস্থা হতে জ্ঞান ফেরার পর বিছানা বা পোশাক এমন ভিজা দেখতে পাওয়া যাকে বীর্য বলে মনে হয় ।
- মেয়েলোকের হায়েয হওয়ার পর পবিত্র হওয়ার জন্য ।
- মেয়েলোকের নেফাস-এর পরে।
সহীহ অভিমত মোতাবেক উক্ত জিনিষগুলো যদিও মুসলমান হওয়ার পূর্বে সংঘটিত হয় তবুও গোসল করা ফরয হবে।
যে সব কারণে গোসল করা ফরয হয় না:
নিম্নলিখিত কারণে গোসল করা ফরয হয় না । যথা :
- লিঙ্গ হতে কিছু বের হলে।
- ওদী বের হওয়া ।
- বীর্যপাতহীন স্বপ্নদোষ হওয়া ।
- সহীহ অভিমত অনুযায়ী রক্তস্রাবহীন সন্তান প্রসব হওয়া ।
- এমন কোন কাপড় পেঁচিয়ে পুরুষাঙ্গ নারীর যোনিতে প্রবেশ করানো, যা মিলনানন্দের জন্য প্রতিবন্ধক
- গুহ্যদ্বারে ঢুশ দেয়া ।
- হাতের আঙ্গুল বা এ ধরনের কোন জিনিষ যোনিতে প্রবেশ করানো।
যখন গোসল করা ওয়াজিব:
যদি কেউ নতুন মুসলমান হয় এবং কাফের অবস্থায় গোসল ফরয হয়ে থাকে, অথচ গোসল করেনি, অথবা শরীয়ত অনুযায়ী গোসল করেনি, তবে তার ওপর গোসল ওয়াজিব হবে।
যদি কেউ পনের বছর বয়সের পূর্বে বালেগ হয় অর্থাৎ স্বপ্নদোষ হয়, তবে তার প্রথম স্বপ্নদোষের জন্য গোসল ওয়াজিব।কিন্তু পরে যে স্বপ্নদোষ হবে তাতে তার ওপর গোসল ফরয হবে।
মৃত মুসলমানকে গোসল দেয়া জীবিত মুসলমানদের ওপর (ওয়াজিব পর্যায়ের) ‘ফরযে কেফায়া’।
যখন গোসল করা সুন্নত:
৪টি কারনে গোসল করা সুন্নত। যথাঃ
- জুমআর নামায আদায় করার জন্য গোসল করা সুন্নত।
- দুই ঈদের নামায আদায় করার জন্য গোসল করা সুন্নত।
- ইহরাম বাধার জন্য গোসল করা সুন্নত।
- আরাফার ময়দানে হাজীদের জন্য সূর্য ঢলে যাওয়ার পর গোসল করা সুন্নত।
যখন গোসল করা মুস্তাহাব:
ষোলটি কারণে গোসল করা মুস্তাহাব। যথা :
- পবিত্র অবস্থায় ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য গোসল করা মুস্তাহাব ।
- বয়সের মাধ্যমে বালেগ হয়েছে এরূপ ব্যক্তির জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- উম্মাদনা হতে যে সুস্থতা লাভ করেছে, তার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- সিঙ্গা লাগানোর পর গোসল করা মুস্তাহাব।
- মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার পর গোসল করা
- শবে বরাতের রাতে গোসল করা মুস্তাহাব।
- শবে কদরের রাতে গোসল করা মুস্তাহাব। যদি তা উপলব্ধি করতে পারে ।
- মদীনা শরীফে প্রবেশ করার পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব
- ইয়াওমুন্নাহার (১০ই জিলহজ্জ) সকালে মুযদালিফায় অবস্থান করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- মক্কা শরীফে প্রবেশ করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- তাওয়াফে যিয়ারত করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- সূর্য গ্রহণের নামাযের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- ইস্তেকার নামায আদায় করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- খউফের (ভয়-ভীতি কালীন) নামায আদায় করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
- সফর হতে বাড়ী পৌঁছে গোসল করা মুস্তাহাব।
- কঠিন ঝড়-ঝঞ্ঝা বায়ু হতে মুক্তির নামাযের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
গোসলের ফরযসমূহ:
গোসলের মধ্যে ফরজ কাজ ৩টি। যথা:
- গড়গড়ার সহিত (রোজাদার না হইলে) কুলি কর
- নাকের ভিতর পানি প্রবেশ করাইয়া ভালরূপ ধৌত করা।
- সমস্ত শরীরে ভালরূপ পানি বহাইয়া দেওয়া।
গোসলের সুন্নতসমূহ
গোসলের মধ্যে সুন্নত কাজ ৬টি। যথা:
- দুই হাত কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করা।
- শরীরে নাপাকী থাকলে প্রথমে তাহা ধুয়ে ফেলা।
- গুপ্তস্থান ধুইয়া নাপাকী সাফ করিয়া লওয়া
- গোসলের পূর্বে ওজু করিয়া লওয়া ।
- মস্তক ও শরীর তিনবার ধৌত করা।
- গোসলের জায়গা হইতে খানিকটা সরিয়া পা ধৌত করা।
গোসলের মুস্তাহাবসমূহ:
গোসলের মধ্যে মুস্তাহাব কাজ ৭টি। যথা—
- মনে মনে নিয়ত করা।
- উভয় হাত ধুইবার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া।
- সারা শরীর ভাল রকম ঘষিয়া মাজিয়া গোসল করা।
- সর্বসাধারণের অগোচরে নির্জন স্থানে গোসল করা।
- গোসল করিবার সময় নিষ্প্রয়োজন কথাবার্তা না বলা ।
- গোসলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি খরচ না করা।
- গোসলের পর গামছা বা তোয়ালে দ্বারা শরীর মুছে ফেলা।
আরও পড়ুন: