তারাবির নামাজের দোয়া, নিয়ত ও মোনাজাত
তারাবির নামাজের বিবরণঃ
তারাবি অর্থ হচ্ছে ক্ষণিক বিশ্রাম । রমযান মাসে ইশার নামাজ পর তারাবির নামাজের প্রতি চার রাকআতের পরে আল্লাহর রাসূল (সঃ) কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন। তাই ফকীহগণ এ নামাজের নামকরণ করেছেন তারাবি অর্থাৎ ক্ষণিক বিশ্রাম।
তারাবির নামাজের নিয়ত:
نَوَيْتُ اَنْ اُصَلِّىَ للهِ تَعَالَى رَكْعَتَى صَلَوةِ التَّرَاوِيْحِ سُنَّةُ رَسُوْلِ اللهِ تَعَالَى مُتَوَجِّهًا اِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيْفَةِ اللهُ اَكْبَرْ
উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা, রাকাআতাই সালাতিত তারাবি সুন্নাতু রাসূলিল্লাহি তায়ালা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।
বাংলা নিয়ত : আমি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তারাবির দুই রাকআত সুন্নাত নামাজের নিয়াত করছি। আল্লাহু আকবার।
তারাবির নামাজের দোয়া:
سُبْحانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ سُبْحانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظْمَةِ وَالْهَيْبَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوْتِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِيْ لَا يَنَامُ وَلَا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدَ سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّنا وَرَبُّ المْلائِكَةِ وَالرُّوْحِ
উচ্চারণ : সোবহানা ফিলমুলকি ওয়াল মালাকুতি, সোবহানা ফিলইয্যাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়া য়ি ওয়াল জবাকৃতি, সোবহানাল মালিকিল হাইয়্যিপ্রার্থী লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামৃত আবাদান আবাদান, সুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালাইকাতি ওয়াররূহ।
প্রতি চার রাকআত শেষে উল্লেখিত দোয়া পড়ার পর কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা ছাড়া নিম্নের মোনাজাত করা যায়। বিশ রাকআত শেষে একত্রেও করা যায়। না করলেও দোষের কিছু নেই।
তারাবির নামাজের মোনাজাত:
اَللَهُمَّ اِنَّا نَسْئَالُكَ الْجَنَّةَ وَ نَعُوْذُبِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةَ وَالنَّارِ- بِرَحْمَتِكَ يَاعَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَاجَبَّارُ يَاخَالِقُ يَابَارُّ اَللَّهُمَّ اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ- بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّحِمِيْنَ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযু বিকা মিনান নারি, ইয়া খালিকাল জান্নাতি ওয়াননারি, বিরাহমাতিকা ইয়া আযীযু ইয়া গাফ্ফারু ইয়া কারীমু ইয়া সাত্তারু ইয়া রাহীমু ইয়া জাব্বারু ইয়া খালিকু ইয়া বা বৃরু, আল্লাহুম্মা অজিরনা মিনান্নারি ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীৰু ইয়া মুজীরু বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।
অর্থ:ইয়া আল্লাহ্! আমরা তোমার নিকট বেহেশত প্রার্থনা করি এবং দোযখ হইতে তোমার আশ্রয় চাহিতেছি। হে বেহেশত ও দোযখের সৃষ্টিকর্তা! তোমারই কৃপা দ্বারা, হে সর্বজয়ী! হে অতি ক্ষমাশীল! হে মহান দয়ালু! হে বৃহৎ দোষ-আচ্ছাদনকারী! হে কৃপাময়। হে মহৎ শক্তিধর। হে মহান সৃষ্টিকর্তা। হে উপকারী। হে আল্লাহ! আমাদিগকে দোষথ হইতে রক্ষা কর। হে মুক্তিদাতা। হে ত্রাণকর্তা! হে রক্ষাকারী। হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। তোমারই আপন অনুগ্রহে আমাদিগকে জাহান্নামের আগুন হইতে রক্ষা কর।
তারাবির নামাজের দোয়া ও মোনাজাত জানা না থাকলে করণীয়:
এ দোয়া কোন সহীহ হাদীসে উল্লেখ নেই। আবার এমন কিছু লোক আছে, যারা এই দোয়া না জানার কারণে তারাবির নামাজই আদায় করে না। এ সকল লোকদেরকে বুঝিয়ে দেয়া দরকার যে, এ দোয়া পাঠ না করলে নামাযের কোন ক্ষতি হয় না। নামাজ হয়ে যাবে। যদি পারে তাহলে শুধু
(সুবহানাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লা-হিল আযীম) পাঠ করবে। কিছু পাঠ না করে চুপ করে বসে থাকলেও নামাজের কোন ক্ষতি নেই। প্রতি চার রাকআত পর মুনাজাত করা দুরন্ত আছে, কিন্তু বিশ রাক’আতের পর বেতরের নামাজের পূর্বে মোনাজাত করাই উত্তম।
তারাবির নামাজের রাকআতের সংখ্যা :
ইমাম আবু হানিফা (রহঃ)-এর মতে তারাবির নামাজই ২০ রাকআত। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)-ও ইহা গ্রহণ করেছেন ।
হযরত জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) তাঁদেরকে সাথে নিয়ে তারাবির নামাজ ৮ রাকআত আদায় করেছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, মহানবী (সঃ) তারাবির নামাজ ২০ রাকআত আদায় করেছিলেন। অবশ্য কোন কোন মুহাদ্দিস এ হাদীসকে সনদগত দিক দিয়ে যয়ীফ বলেছেন; কিন্তু এর মর্ম সহীহ। কেননা ইমাম বায়হাকী (রহঃ)-এর এক সহীহ বর্ণনায় আছে, হযরত ওমর ফারুক (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ) এবং হযরত আলী (রাঃ)-এর যুগে তারাবির নামাজ ২০ রাকআত আদায় করা হতো ।
মহানবী (সঃ) যদি তারাবির নামাজ ২০ রাকআত না-ই আদায় করতেন তাহলে তাঁরা ২০ রাকআত আদায় করতে কোন অবস্থাতেই সাহস করতেন না। এবং অপর সাহাবীরাও অবশ্যই এর প্রতিবাদ করতেন। সুতরাং বুঝা যায়, মহানবী (সঃ) প্রথম দিকে তারাবির নামাজ ৮ রাকআত আদায় করতেন এবং শেষের দিকে ২০ রাকআত আদায় করেছেন। ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) শেষ অবস্থাটিই গ্রহণ করেছেন।
সুতরাং তারাবির নামায ২০ রাকআত হওয়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) এবং সর্বযুগের মুসলিম উম্মাহ ও মুজতাহিদ ইমামগণ ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
তারাবির নামাজ আদায় করার নিয়ম:
হাদীসে সালাতুত তারাবি বলে কোন শব্দ নেই। বরং হাদীসে বলা হয়েছে, মান কামা রামাদানা ঈমানান ওয়া ইত্তিসাবান গুফিরা লাহু মা তাক্বাদ্দামা মিন জামবিহি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি রমযান মাসে ঈমান ও ইখলাসের সাথে কিয়াম করবে,তারাবীহ নামাযের ওয়াক্ত।
ইশার নামাজ আদায় করার পর অর্থাৎ ইশার চার রাকআত ফরয, তারপর দু’রাকআত সুন্নত নামাজ আদায় করার পর তারাবির নামাজ দু’রাকআত করে আদায় করতে হয় । এভাবে মোট বিশ রাকআত নামাজ আদায় হবে।
একাকী দু’রাকআত সুন্নত নামাজ আদায় করার যে নিয়ম রয়েছে, তারাবির নামাজও একই নিয়মে আদায় করতে হয়। শুধু কারণবশতঃ তারাবির নামাজেরর নিয়ত করতে হবে।
একাকী নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে দু’রাকআতের নিয়ত করার পর প্রতি রাকআতে সূরা ফাতিহাসহ অন্য একটি করে সূরা পাঠ করতে হবে।
আর জামাআতে নামাজ আদায় করার ক্ষেত্রে ইমাম সাহেবের পিছনে কোন সূরা কিরাত পাঠ করতে হবে না। মনোযোগের সাথে ইমাম সাহেবের কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ করতে হবে। দু’রাকআত শেষ করে বসে আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ শরীফ এবং দোয়া মাসূরা পাঠ করে দু’দিকে সালাম ফিরায়ে পুনরায় দু’রাকআতের নিয়ত করতে হবে।
চার রাকআত নামাজ আদায় করা হলে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিবে। বিশ্রাম নেয়া মুস্তাহাব। বিশ্রাম নেয়ার সময় উপরোক্ত দোয়া বা অন্য যে কোন দোয়া বা তাসবিহ পাঠ করা যায়। তবে এ দোয়া পাঠ করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। চুপচাপ বসে থাকলেও কোন গুনাহ বা নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না।
আমাদের দেশে অনেকেই আছেন যারা উক্ত দোয়া জানেন না বলে নামাযজ আদায় করতে চান না। এটা অত্যন্ত ভুল এবং অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু নয়। এ সব দোয়া ও মোনাজাত নামাজের কোন অংশ নয়।
প্রতি চার রাকআত নামাজের পর সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা যায়। আবার বিশ রাকআত শেষ করে বিতির নামাজের পূর্বে মুনাজাত করাই উত্তম ।
- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত, সময় এবং ফজিলত
- জানাজার নামাজের দোয়া, নিয়ম এবং নিয়ত
- রোজার নিয়ত, রোজা ভঙ্গের কারণ এবং রোজার ফজিলত
- দোয়া কুনুত আরবি, বাংলা উচ্চারণ ও অর্থ
এশার নামাজ অথবা তারাবির নামাজ ছুটে গেলে করণীয়ঃ:
তারাবির নামাজের পূর্বে এশার নামাজ অবশ্যই আদায় করতে হবে। ভুলক্রমে এশার নামাজ আদায় না করে তারাবির ও বিতির নামাজ আদায় করে থাকলে পুনরায় ইশা, তারাব্জও বিতির নামাজ পর্যায়ক্রমে আদায় করতে হবে।
ইশার জামাআত হয়ে যাওয়ার পর কেউ মসজিদে এলে সে প্রথমে একাকী ইশার নামাজ আদায় করে নিবে এবং পরে তারাবির নামাজে জামাআতের সাথে অংশ নিবে। জামাআতে তারাবির নামাজ দু’চার রাকআত ছুটে গিয়ে থাকলে মুক্তাদী বিতির নামাজ ইমামের সাথে জামাআতে আদায় করার পর একাকী ছুটে যাওয়া তারাবির নামাজ আদায় করবে।
তবে একাধিক ব্যক্তির এরূপ অবস্থা হয়ে থাকলে তারা বিতিরের পর স্বতন্ত্র জামাআত করেও ছুট যাওয়া তারাবির নামাজ আদায় করতে পারে। কেননা, তারাবির নামাজের ওয়াক্ত বিতিরের পরেও থাকে। তাই ছুট যাওয়া তারাবির জন্য বিতিরের জামাআত ছেড়ে দেয়া উচিত নয়।
কোন কারণবশতঃ তারাবির নামাজ বাতিল হয়ে গেলে বা আদায় করতে না। পারলে সুবহে সাদিক পর্যন্ত তা আদায় করার সময় থাকে।
সূরা তারাবির আদায়ের নিয়ম:
১। সূরা তারাবির মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় রাকআতে কুরআনের যে কোন অংশ বা যে কোন সূরা পড়তে পারবে অথবা দ্বিতীয় রাকআতে প্রতিবারই সূরা ইখলাছ পড়লেও জায়েয আছে (শামী ২/৪৭, দারুল উলূম ৪/২৫১)
২। সূরা ফীল হতে সূরা নাস্ পর্যন্ত দশটি সূরার দ্বারা দশ রাকআত পড়ে আবার সূরা ফীল হতে নাস পর্যন্ত বাকী দশ রাকআত পড়ে নিবে। (শামী ২/৪৭)
রমযানের চাঁদ উঠার পর হইতে শাওয়াল মাসের চাঁদ না উঠা পর্যন্ত ১ মাস এশার নামাজের পর বেতের নামাজের পূর্বে দুই দুই রাকআত করে ১০ সালামে ২০ রাকআত নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজকে তারাবির নামাজ বলা হয় । এই নামাজ জামাআতের সহিত পড়া সুন্নতে মোআক্কাদায়ে কেফায়া । ওযরবশতঃ একাও পড়া চলে । তারাবি নামাজে সারা রমযান মাসে একবার কোরআন শরীফ খতম করা সুন্নত। যদি ইমাম হাফেয না হন তবে প্রত্যেক রাকআতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস অথবা অন্য সূরা বা আয়াত পড়বে। এই নামায একা পড়লে বেতেরের নামাজ ও একা পড়বে। কিন্তু তারাবীর নামায জামাআতে পড়লে অধিক সওয়াব হবে ।
তারাবির নামাজের ফজিলতঃ
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, হযরত রাসূলে করীম (সঃ) রমযান মাসের নামায কায়েম করার জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন। কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে খুব তাগিদ করতেন না বরং এরূপ বলতেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে রমযান মাসে কিয়াম করবে (অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে) তার পূর্ববর্তী (সগীরা) গুনাহসমূহ মাফ হয়ে যাবে ।
অপর হাদীসে মহানবী (সঃ) ইরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ পাক তোমাদের উপর রমযান মাসে দিনের বেলায় রোজা ফরয করেছেন এবং রাতের বেলায় তারাবির নামাজ সুন্নত করেছেন । অতএব, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে এ মাসে দিনের বেলায় রোজা রাখবে এবং রাতে কিয়াম করবে (অর্থাৎ তারাবির নামাজ আদায় করবে) তার পূর্বকৃত সমস্ত (সগীরা) গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
উপসংহার
আশা করি আজকের আর্টিকেলে আপনারা তারাবির নামাজ আদায় করার নিয়ম, তারাবির নামাজের দোয়া এবং তারিবির নামাজের নিয়ত সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পেরেছেন।
আর্টিকেলটি ভালো লেগে থাকলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন।
আপনার জন্য আরও আর্টিকেলসমূহ: