দেশপ্রেম কাকে বলে ? দেশপ্রেম প্রয়োজন কেন
আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা দেশপ্রেম কি বা দেশপ্রেম কাকে বলে, দেশপ্রেম প্রয়োজন কেন, একজন দেশপ্রেমিক নাগরিকের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানব।

চলুন দেশপ্রেম কি বা কাকে বলে এ বিষয়ে প্রথমে জেনে নিই।
দেশপ্রেম কাকে বলে ?
নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা ও গভীর শ্রদ্ধা দেখানোই হচ্ছে দেশপ্রেম।স্বদেশপ্রীতি মানুষের মাঝে জন্ম দেয় মহৎ হওয়ার গুণাবলি।
ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। প্রতিটি মানুষ জন্ম নেয় পৃথিবীর একটা নির্দিষ্ট ভূ খণ্ডে যা তার কাছে স্বদেশ। এই স্বদেশের সঙ্গেই গড়ে ওঠে তার নাড়ির সম্পর্ক।
স্বদেশের জন্য তার মনে জন্ম নেয় এক নিবিড় ভালোবাসা। দেশের প্রতি এই অনন্য ভালোবাসাই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। এই প্রেমই স্বদেশের প্রতি আমাদের অনুরক্ত করে তোলে।
কবিকণ্ঠে তাই হৃদয়মথিত প্রগাঢ় উচ্চারণ, “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।”
দেশপ্রেম জাগ্রত হয় মূলত আত্মসম্মানবোধ থেকে। যে জাতির আত্মসম্মানবোধ যত প্রখর, সে জাতির দেশপ্রেম তত প্রবল। আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস এ স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জ্বল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ আমাদের স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসলেই কেবল বলা যায়, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।
নিজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয় স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা। স্বদেশের মাটি বাতাস পানির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। জন্মভূমির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার শেকড়ের বন্ধন। মা, মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি মানুষের যে চিরায়ত ভালোবাসা তারই আবেগময় প্রকাশ ঘটে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে।
স্বদেশপ্রেমের আবেগময় বাণীরূপ আমরা দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ বন্দনায় সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। সার্থক জনম মা গো, তোমায় ভালোবেসে।
দেশপ্রেম কি বা কাকে বলে ?
দেশপ্রেম প্রাণহীন শব্দমাত্র নয়। নিছক কোনো বিমূর্ত আদর্শও নয়। দেশপ্রেম এক পবিত্রতম অনুভূতি, এক দ্রোহের উচ্চারণ। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি গভীর আকর্ষণ থেকেই স্বদেশপ্রেমের জন্ম। এ কারণে জন্মভূমিকে মানুষের কাছে স্বর্গের চেয়েও সেরা মনে হয়।
এই স্বদেশ চেতনাই কবি জীবনানন্দের অন্তরে সঞ্চার করেছিল এক গভীর অভিব্যক্তি বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।
স্বদেশপ্রেম মানবচিত্তে ফল্গুধারার মতো সদা বহমান। কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে, বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে তার আবেগোচ্ছল প্রকাশ ঘটে। যখন দেশের মানুষের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন হয়, তখন ধর্ম বর্ণ গোত্রভেদের ঊর্ধ্বে দেশাত্মবোধের চেতনা দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে।
স্বদেশপ্রেমের সেই শুভ উদ্বোধনে তখন অন্তর জুড়ে বালে স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, স্মৃতি দিয়ে তৈরি স্বদেশ বন্দনার গান: সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।
আবার কখনো পরাধীনতার দুঃখ বেদনায়, ভিনদেশি শাসকের শাসন শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুক্তিব্রতে শামিল হওয়ার সময়ে স্বদেশপ্রেম জাতীয় জীবনে ঐক্য ও প্রেরণার সৃষ্টি করে।
স্বদেশপ্রেম দেশ ও জাতির অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রেরণাময় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একই চেতনায় একপ্রাণ হয়ে মহৎ লক্ষ্য সাধনে ব্রতী করে। কখনো কখনো স্বদেশপ্রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিদেশে ভিন্নতর জীবন পরিবেশে। তখন স্বদেশের মানুষ ও প্রকৃতির জন্য জাগে অসীম আকুলতা।
দীর্ঘ প্রবাস জীবনে অনেক সুখের মধ্যে থেকেও দেশের তরুলতা ঘেরা ছায়াচ্ছন্ন জীর্ণ কুটিরের জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। যেমনটি ঘটেছিল মাইকেল মধুসূদনের ক্ষেত্রে, বহুদেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
স্বদেশপ্রেমের ভিন্নতর বহিঃপ্রকাশ
স্বদেশপ্রেমের প্রকাশ বিভিন্ন ভাবে ঘটতে পারে। কেবল সংকটে, স্বাধীনতা সংগ্রামেই যে দেশপ্রেমের স্ফূরণ হয় এমন নয়। শিল্প সাহিত্য চর্চায়, দেশগঠন, জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনাতেও স্বদেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
দেশের কল্যাণে ও অগ্রগতিতে ভূমিকা রেখে, বিশ্ব সভ্যতায় অবদান রেখে দেশের গৌরব বাড়ানো যায়। বিশ্বসভায় দেশ মহিমান্বিত আসন লাভ করতে পারে।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জগদীশচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখের অবদানে বিশ্বে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে আছে।
দেশপ্রেম প্রয়োজন কেন এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকের বৈশিষ্ট্য
স্বদেশপ্রেম বিশ্বপ্রেমেরই একটি অংশ। তাই প্রকৃত স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেমের মধ্যে কোনো বিরোধ থাকতে পারে না। স্বদেশপ্রেম যদি বিশ্বমৈত্রী ও আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের সহায়ক না হয় তবে তা প্রকৃত দেশপ্রেম হতে পারে না।
স্বদেশবাসীকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্ববাসীকে ভালোবাসতে শেখে। দেশপ্রেম এর সঙ্গে বিশ্বমৈত্রীর গভীর যোগসূত্র আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ, শেকসপিয়র, আইনস্টাইন কেবল স্ব স্ব দেশের নন, তাঁরা সমগ্র মানব জাতির।
দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিভূ পৃথিবীর দেশে দেশে যাঁরা দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে বরণীয় স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁরা সারা বিশ্বের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেসব বাঙালি অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে নেতাজি সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানি জাতিকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
ইতালির গ্যারিবান্ডি, আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাও সেতুং, ভিয়েতনামের হো চি মিন, তুরস্কের মোস্তফা কামাল পাশা, ভারতের মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ দেশপ্রেমের জন্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের দেশপ্রেম বিশ্বের কাছে অবাক বিস্ময় হয়ে আছে।
মানুষের জীবনে দেশপ্রেম এক মহৎ চেতনা। এটি মানুষকে স্বার্থপরতা, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতা, রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভেদাভেদ থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে সহায়তা করে। উদ্বুদ্ধ করে দেশের কল্যাণে স্বার্থত্যাগ করে আত্মনিবেদন করতে।
তাই ক্ষমতার লোভ ও দলীয় স্বার্থ চিন্তা কখনো সত্যিকার দেশপ্রেম হতে পারে না। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
একুশ শতকের পৃথিবীতে বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য আজ দরকার দেশগঠনের কাজে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করা।
এজন্য আজ চাই সমৃদ্ধ দেশ গঠনের লক্ষ্যে জাতীয় জাগরণ। তাহলেই দেশ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারায় অগ্রসর হতে পারবে।
সর্বশেষ
দেশপ্রেম কাকে বলে বা দেশপ্রেম কি এ বিষয়ে আশা করি আপনারা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন।
নিজের দেশের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ দেখানোই হচ্ছে দেশপ্রেম।
প্রিয় মাতৃভূমিকে তাই মাতৃজ্ঞান করে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে।
Learn more: