নিউটনের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সূত্র ব্যাখা ও উদাহরণসহ
এই আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা নিউটনের প্রথম সূত্র, দ্বিতীয় সূত্র এবং তৃতীয় সূত্র এর বিবৃতি উদাহরণ সহ জানবো।

নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে বলের গুণগত ধারণা
নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা জানি যে , কোনাে বস্তুই নিজের থেকে এর অবস্থান পরিবর্তন করতে চায় না ।
বস্তু স্থির থাকলে স্থির থাকতে চায় , গতিশীল থাকলে গতিশীল থাকতে চায় । বস্তুর অবস্থান পরিবর্তনের জন্য বাইরে থেকে কিছু একটা প্রয়ােগ করতে হয় । যা বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন করে বা করতে চায় , তাকেই বল বলা হয়।
তাই নিউটনের প্রথম সূত্র থেকে আমরা বলের গুণগত সংজ্ঞা পাই।
নিউটনের প্রথম সূত্র অনুসারে- যা স্থির বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তাকে গতিশীল করে বা করতে চায় বা যা গতিশীল বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তার গতির পরিবর্তন করে বা করতে চায় , তাকে বল বলে । নিচের ঘটনাটি থেকে বলের ধারণা আরও সুস্পষ্ট হবে ।
একটি ছেলেকে যদি একটি নৌকা টানতে এবং ঠেলতে দেখা যায় । তুমি কি মনে কর উভয় ক্ষেত্রেই নৌকাটি গতিশীল হবে ? আসলে এটা নির্ভর করবে ছেলেটি কতটা সবল তার উপর।
যদি ছেলেটি যথেষ্ট সবল হয় , তবে নৌকাটি গতিশীল হবে । আর যদি ছেলেটি যথেষ্ট সবল না হয় , তাহলে নৌকাটি কেবল গতিশীল হতে চেষ্টা করবে , সেটি স্থিরই থাকবে ।
একইভাবে কোনাে গতিশীল বস্তুকে তুমি কেবল থামাতে পারবে যদি তুমি থামাবার মতাে যথেষ্ট বল প্রয়ােগ করতে পার । যদি তুমি না পার , তবে কেবল থামাতে সচেষ্ট হবে ।
সুতরাং আমরা বলতে পারি : যা স্থির বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তাকে গতিশীল করে বা করতে চায় অথবা গতিশীল বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তার গতির পরিবর্তন করে বা করতে চায় তাকে বল বলে ।
বলের প্রভাব বল নিচের ঘটনাগুলাে ঘটাতে পারে ।
- বল একটি স্থির বস্তুকে গতিশীল এবং গতিশীল বস্তুকে স্থির করতে পারে ।
- বলএকটি বস্তুর গতির দিক পরিবর্তন করতে পারে ।
- বল একটি গতিশীল বস্তুর বেগ হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারে ।
- বল একটি বস্তুর আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে ।
বলের প্রকৃতি
স্পর্শ বল: কোনাে কোনাে বল বস্তুর সরাসরি বা ভৌত সংস্পর্শে এসে বস্তুর উপর ক্রিয়া করে । মনে কর , তুমি যদি এক বালতি পানি বহন করতে চাও তাহলে তােমাকে বালতির হাতল ধরে বল প্রয়ােগ করতে হবে ।
তুমি যদি তােমার স্কুল ব্যাগ উঠাতে চাও তাহলে তােমাকে এর হাতলে ধরতে হবে এবং বল প্রয়ােগ করতে হবে । এগুলাে পেশিজ বল । যে বল কেবল দুটি বস্তুর ভৌত সংস্পর্শে এসে পরস্পরের উপর ক্রিয়া করে তাকে স্পর্শ বল
বলে । এ ধরনের বল হলাে পেশিজ বল ও ঘর্ষণ বল । এখানে আমরা ঘর্ষণ বল নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করব ।
ঘর্ষণ বল: দুটি বস্তু পরস্পরের সংস্পর্শে থেকে যদি একে অপরের ওপর দিয়ে চলতে চেষ্টা করে অথবা চলতে থাকে তাহলে বস্তুদ্বয়ের স্পর্শতলে এ গতির বিরুদ্ধে একটা বাধার উৎপত্তি হয় , এ বাধাকে ঘর্ষণ বলে ।
আর এ বাধার ফলে যে বল উৎপন্ন হয় তাকে ঘর্ষণ বল বলে । ঘর্ষণ হচ্ছে অতি সাধারণ একটি বল ।
যখন কোনাে বস্তু অন্য বস্তুর ওপর দিয়ে চলতে চেষ্টা করে , তখন ঘর্ষণ বস্তুটিকে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করে । ঘর্ষণ সর্বদা গতিকে বাধা দেয় ।
একইপরিমাণ বল দিয়ে একটি মার্বেলকে পাকা ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে দাও । দেখ কতটুকু দূরত্ব পর্যন্ত গেল । এবার মার্বেলটি সমপরিমাণ বল দিয়ে রাস্তায় গড়িয়ে দাও , দেখ কী পরিমাণ দূরত্ব গেল । কোন ক্ষেত্রে মার্বেলটি বেশি দূরত্ব অতিক্রম করেছে ? এই কাজটি থেকে দেখা যায় যে পৃষ্ঠ যত বেশি মসৃণ , ঘর্ষণ তত কম । তাই মসৃণ তলে মার্বেলটি অমসৃণ তলের চেয়ে বেশি দূর পর্যন্ত গিয়েছে ।
ঘর্ষণ বল শুধু চলমান বস্তুকেই থামিয়ে দেয় না , স্থির বস্তুকেও গতিশীল হতে বাধা দেয় । কোনাে অমসৃণ বা খসখসে পৃষ্ঠে কোনাে পাথরকে গতিশীল করা তাই কষ্টকর । ঘর্ষণ বল দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে ।
এরা হলাে ১. বস্তুর ভর : বস্তুর ভর বেশি হলে ঘর্ষণ বল বেশি উৎপন্ন হবে । ২. পৃষ্ঠের প্রকৃতি : পৃষ্ঠ অমসৃণ , খসখসে বা এবড়াে থেবড়াে হলে ঘর্ষণ বল বেশি উৎপন্ন হবে ।
প্রত্যেক তলে কিছু উঁচু – নিচু খাজ থাকে যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না । কোনাে বস্তু যখন অপর বস্তুর ও টেনে বা ঠেলে নেয়া হয় , তখন এদের তলের এ উচু – নিচু খাঁজ করাতের পাতের মতাে একে অপরের সাথে আটকে যায় , ফলে একটি তলের ওপর দিয়ে অপর তলের গতি বাধাপ্রাপ্ত হয় ।
এ উঁচু – নিচু খাজ যত বেশি হবে অর্থাৎ তল যত বেশি অমসৃণ হবে , এক তলের ওপর দিয়ে অপর তলের গতি তত বেশি বাধা পাবে , সুতরাং ঘর্ষণ বল তত বেশি হবে ।
ঘর্ষণের সুবিধা ও অসুবিধা : আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ঘর্ষণ অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় ।
ঘর্ষণ না থাকলে আমরা হাঁটতে পারতাম না , পিছলে যেতাম । কাঠে পেরেক বা স্কু আটকে থাকত না , সম্ভব হতাে না দড়িতে কোনাে গিৱাে দেওয়া । ঘর্ষণ আছে বলেই আমরা হাত দিয়ে খাতা , কলম , বইসহ যাবতীয় জিনিস ধরতে পারি । গাড়ি বা সাইকেলের টায়ার ও ব্রেকের ঘর্ষণের ওপর আমাদের জীবন নির্ভরশীল ।
বাতাসের ঘর্ষণ আছে বলেই প্যারাসুট ব্যবহার করে কেউ বিমান থেকে নিরাপদে নামতে পারে । পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশকালে উল্কা বায়ুর সাথে ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ।
যন্ত্রপাতির যে সকল অংশ পরস্পরের সাথে ঘষা খায় সেগুলাে ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় । সময়ের সাথে সাইকেল , রিক্সা ও গাড়ির টায়ার ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ।
পেন্সিল দিয়ে লিখতে থাকলে এর মাথা ভোঁতা হয়ে যায় । তুমি কি নতুন জুতাে ও পুরাতন জুতাের সােলের পার্থক্য লক্ষ করেছ ? ঘর্ষণের ফলে জুতাের সােল ক্ষয়ে যায় ।
যন্ত্রের দক্ষতা হ্রাস পায় আবার ঘর্ষণের ফলে অনাবশ্যক তাপ উৎপন্ন হয় , এতেও যন্ত্রের ক্ষতি হয় ।
ঘর্ষণকে সীমিতকরণ: আমাদের কাজ – কর্ম ও জীবনযাপন সহজ করার জন্য কখনাে ঘর্ষণকে কমাতে হয় আবার কখনাে ঘর্ষণকে বাড়াতে হয় । বিভিন্ন প্রয়ােজনে তাই ঘর্ষণকে সীমিত করার দরকার হয় । কোনাে তলকে খুব মসৃণ করে ঘর্ষণকে কমানাে যেতে পারে । অনেক স্কুলে বা পার্কে শিশুদের খেলার জন্য স্লাইড থাকে । এটাকে খুব মসৃণ করে তৈরি করা হয় , যাতে শিশুরা সহজে পিছলে নামতে পারে । তেল বা গ্রিজ তলগুলােকে মসৃণ করে এবং ঘর্ষণকে কমিয়ে দেয় ।
এ কারণে যন্ত্রপাতির গতিশীল অংশগুলাে তেল বা গ্রিজ দ্বারা আবৃত থাকে যা ঘর্ষণকে কমায় এবং যন্ত্রপাতিকে ক্ষয় – ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে । তেল এবং গ্রিজের মতাে পদার্থ যা ঘর্ষণ কমানাের জন্য ব্যবহূত হয় তাদেরকে লুব্রিকেন্ট বলে ।
ঘর্ষণ কমানাের আর একটি উপায় হচ্ছে কোনাে তলের ওপর দিয়ে একটি বস্তুকে পিছলিয়ে নেওয়ার চেয়ে গড়িয়ে নেওয়া । তুমি নিশ্চয় লক্ষ করেছ , কোনাে কোনাে স্যুটকেসে চাকা লাগানাে থাকে । এই স্যুটকেসকে যদি তুমি চাকা না লাগানাে অবস্থায় কোনাে মেঝের উপর দিয়ে টেনে নাও আর চাকা লাগানাে অবস্থায় টেনে নাও তাহলে কোনাে পার্থক্য অনুভব করবে কি ? তুমি নিশ্চয়ই বলবে চাকা লাগানাে অবস্থায় টানা অনেক সহজ ।
কোনাে ভারী বস্তুকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর সহজ করার জন্য রােলার ব্যবহার করা হয় । অনুরূপভাবে যন্ত্রপাতির গতিশীল অংশগুলাের মাঝে অনেক সময় বল বিয়ারিং বসিয়ে ঘর্ষণ কমানাে হয় এবং গতি সহজ করা হয় । বল বিয়ারিং হচ্ছে স্টিলের ক্ষুদ্র বল ।
তলকে অমসৃণ করে ঘর্ষণ বাড়ানাে হয় । যখন কোনাে দেয়াশলাইয়ের কাঠিকে দেয়াশলাইয়ের বাক্সের পাশে টানা হয় , তখন দেয়াশলাইয়ের কাঠির মাথা এবং অমসৃণ তলের মধ্যকার ঘর্ষণের ফলে দেয়াশলাইয়ের কাঠির মাথার রাসায়নিক দ্রব্যাদি । জ্বলে ওঠে এবং আমরা আগুন পাই ।
হাঁটার জন্য ঘর্ষণ খুবই প্রয়ােজনীয় । তুমি যদি তােমার জুতাের সােল পরীক্ষা করে দেখ , তাহলে দেখতে পাবে তা ঢেউ খেলানাে । জুতাে ও রাস্তার মধ্যবর্তী ঘর্ষণ বাড়ানাের জন্য এরূপ করা হয় । এতে জুতো ভালােভাবে রাস্তাকে অবল ; ধরে রাখতে পারে ।
অনুরূপভাবে , গাড়ির টায়ারে সুতাে থাকে যাতে টায়ার সড়ককে ভালােভারে আকড়ে ধরে রাংরা পারে এবং যাতে ভিজা রাস্তা থেকে গাড়ি স্কিড করে পড়ে না যায় । যদিও ঘর্ষণ আমাদের অনেক ভােগান্তির কারণ , তবুও আমরা ঘর্ষণ ছাড়া জীবন কল্পনা করতে পারি না ।
তাই ঘর্ষণকে বলা হয় প্রয়ােজনীয় উপদ্রব বা অপশক্তি ।
অস্পর্শ বল কিছু বল আছে যা বস্তুর ভৌত সংস্পর্শে না এসেও বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে । এ ধরনের বলকে অস্পর্শ বল বলে ।
এ ধরনের কল হলাে : মাধ্যাকর্ষণ বল , চৌম্বক বল , তাড়িতচৌম্বক বল , দুর্বল নিউক্লিয় বল ও শক্তিশালী নিউক্লিয় বল ।
মাধ্যাকর্ষণ বল : কোনাে ঢিলকে উপরের দিকে ছুড়ে দিলে কী ঘটে ? আম গাছ থেকে পাকা আম মাটিতে পড়ে কেন ? এর কারণ , এ মহাবিশ্বের সকল বস্তু এদের ভরের দরূণ পরস্পরের ওপর বল প্রয়ােগ করে বা একে অপরকে নিজের দিকে টানে । এই বলকে বলা হয় মাধ্যাকর্ষণ বল । এই বলের কারণেই পৃথিবী সকল বস্তুকে এর নিজের দিকে টানে । পৃথিবীর এই টানকে আমরা বলি অভিকর্ষ বল । মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্য পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘােরে এবং চাদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘােরে ।
এই বলের মান বস্তু দুটির ভর ও এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের ওপর নির্ভর করে । বস্তুর ভর যত বাড়ে , এই বলের মান তত বাড়ে , কিন্তু বস্তু দুটির মধ্যবর্তী দূরত্ব যত বাড়ে , এই বলের মান দূরত্বের বর্গের অনুপাতে কমে । মাধ্যাকর্ষণ বল সবসময়ই আকর্ষণধর্মী ।
চৌম্বক বল : চুম্বক পেরেক , আলপিন ও লােহা বা স্টিলের তৈরি অন্যান্য বস্তুকে আকর্ষণ করে । দুটি দন্ড চুম্বককে কাছাকাছি আনলে এরা পরস্পরকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে । সুতরাং চুম্বকের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ করার ক্ষমতা আছে । দুটি চুম্বককে কাছাকাছি আনলে এরা পরস্পরের প্রতি যে বল প্রয়ােগ করে এবং কোনাে চুম্বক অন্য কোনাে চৌম্বক পদার্থে (লােহা , নিকেল , কোবাল্ট , স্টিল ইত্যাদি) যে বল প্রয়ােগ করে , তাকে চৌম্বক বল বলে । এই বল আকর্ষণ ও বিকর্ষণ উভয়ধর্মী হতে পারে ।
তড়িতচৌম্বক বল : দুটি আহিত (চার্জযুক্ত) কণিকার মধ্যে যে বল ক্রিয়াশীল তাকে তাড়িতচৌম্বক বল বলে । তাড়িতচৌম্বক বল কণিকা দুটির আধানের গুণফলের সমানুপাতিক এবং এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক ।
এই বল আকর্ষণ ও বিকর্ষণ উভয়ধর্মী হতে পারে । তাড়িত চৌম্বক বল পরমাণুর গড়ন , রাসায়নিক বিক্রিয়া ও অন্যান্য তাড়িতচৌম্বক ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
দূর্বল নিউক্লিয় বল: এই বল তাড়িতচৌম্বক বলের চেয়ে ১০১০ গুণ দুর্বল । মৌলকণিকা লেপটন ও হার্ডনের ক্ষয়প্রাপ্তিতে এই বল কাজ করে । কোনাে কণিকা ও নিউক্লিয়াসের বিটাক্ষয়ের জন্য এই বল দায়ী ।
শক্তিশালী নিউক্লিয় বল : আমরা জানি , সকল পদার্থ পরমাণু দিয়ে গড়া । পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস এবং একে কেন্দ্র করে ঘােরে ইলেকট্রন । নিউক্লিয়াসে থাকে প্রােটন ও নিউট্রন । এদের বলা হয় নিউক্লিয়ন ।
যে শক্তিশালী আকর্ষণ বল নিউক্লিয়নগুলাের মধ্যে কাজ করে এবং নিউক্লিয়াসকে আটকে বা ধরে রাখে তাকে শক্তিশালী নিউক্লিয় বল বলে । এই বলের পাল্লা অতি ক্ষুদ্র , নিউক্লিয়াসের বাইরে কাজ করে না । তবে এই বল তড়িত চৌম্বক বলের চেয়ে ১০০ গুণ শক্তিশালী । এই বল আকর্ষণধর্মী ।
গতি প্রবর্তন করতে হলে তথা তার গতি বাড়াতে বা কমাতে হলে কিংবা গতির দিক পরিবর্তন করতে হলে বল প্রয়োগ ।
বলের পরিমাপ ও নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র – বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক
আমরা জেনেছি , বস্তুর গতির অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে অর্থাৎ স্থির বস্তুকে গতিশীল করতে হলে বা গতিশীল বস্তুর করতে হবে ।
বস্তুর জড়তা থাকার কারণে এ বল প্রয়ােগ করতে হয় । যে বস্তুর জড়তা যত বেশি , তার অবস্থা পরিবর্তনের জন্য তত বেশি বল দিতে হবে । আর যেহেতু জড়তার পরিমাপ হচ্ছে ভর , সুতরাং যে বস্তুর ভর যত বেশি হবে তার ওপর প্রযুক্ত বলও তত বেশি হবে ।
আবার একই ভরের দুটি বস্তুর বেগের পরিবর্তন ঘটাতে তথা ত্বরণ সৃষ্টি করতে কী সমান বল লাগবে ? যে বস্তুর তুরণ যত বেশি হবে তার ক্ষেত্রে তত বেশি বলের প্রয়ােজন হবে । সুতরাং দেখা যাচ্ছে , বল বস্তুর ভর ও তুরণ উভয়ের ওপর নির্ভর করে ।
বস্তুর ভর ও ত্বরণের গুণফল দ্বারা বল পরিমাপ করা হয় । সুতরাং , বল = ভর × ত্বরণ
নিউটনের দ্বিতীয় সুত্রটি হলাে , বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক ।
এই সূত্র থেকে আমরা বলের পরিমাপ করতে পারি ।
বস্তুর ভরবেগ হলাে , ভর × বেগ ।
ভরবেগের পরিবর্তনের হার = ভরবেগের পরিবর্তনের হার = ভর × ত্বরণ
কারণ , বেগের পরিবর্তনের হার হলাে তুরণ । সুতরাং নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে আমরা পাই , বল = ভর × ত্বরণ
পদার্থবিজ্ঞানে বলকে F , ভরকে m এবং ত্বরণকে দিয়ে নির্দেশ করা হয় ।
সুতরাং , F = ma যেহেতু বলের মান ও দিক উভয়ই আছে , তাই বল একটি ভেক্টর রাশি । বলের একক নিউটন ।
যে পরিমাণ বল এক কিলােগ্রাম ভরের কোনাে বস্তুর ওপর প্রযুক্ত হয়ে এক মিটার / সেকেন্ড ত্বরণ সৃষ্টি করে তাকে এক নিউটন বলে ।
নিউটনের তৃতীয় সূত্র – প্রতেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে
ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বল অনেককে আমরা রাগ করে টেবিলে জোরে ঘুষি বা থাম্পড় মারতে দেখি । তাতে টেবিলের যাই হােক না কেন তিনি কি হাতে ব্যথা পান । কেন ? আসলে তিনি যখন টেবিলে বল প্রয়ােগ করেন , টেবিলও তাকে একটি বল প্রয়ােগ কর । প্রকৃতিতে বল জোড়ায় জোড়ায় ক্রিয়া করে । যদি A বস্তু B বস্তুর ওপর বল প্রয়ােগ করে তা হলে B বস্তুও A বস্তুর একটি বল প্রয়োগ করে ।
একটি ভারী টেবিলের সামনে একটি চেয়ারে বস । তােমার দিকে টেবিলটিকে টানতে চেষ্টা ও টেবিলটি খুব বেশি ভারী বলে তুমি হয়তাে এটাকে তােমার দিকে গতিশীল করতে পারবে না , কিন্তু তােমার চেয়ারের কী হলাে ? চেয়ারটি টেবিলের দিকে চলে যাচ্ছে । এটি কেন ঘটে ?
টেবিলের ওপর তােমার প্রযুক্ত টানা বলের ফলে চেয়ারের ওপর একটি বিপরীতমুখী বলের সৃষ্টি হয় , যা চেয়ারটিকে টেবিলের দিকে গতিশীল করে ।
একটি শক্ত রাবার ব্যান্ড নাও । দুই হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে একে যথাসম্ভব প্রসারিত করে রাখ । কিছুক্ষণ পর দেখবে তােমার আঙ্গুলগুলােতে ব্যথা করছে । আঙ্গুলের যে স্থানগুলােতে রাবার ব্যান্ড স্পর্শ করেছে , সেখানে চামড়া কিছুটা বিকৃত ( ফুচকে গেছে ) হয়ে গেছে । কেন ?
তুমি রাবার ব্যান্ডকে টান টান করার অর্থ এর আকৃতি পরিবর্তন করার জন্য বল প্রয়ােগ করেছ । এর ফলে রাবার ব্যান্ডও তােমার আঙ্গুলকে বিকৃত করার অর্থাৎ এর আকৃতি পরিবর্তন করার জন্য কিছু একটা করছে ।
উপযুক্ত কাজ থেকে আমরা দেখতে পাই , যখনই আমরা কোনাে বল প্রয়ােগ করি , তখনই তার ফলে একটি বিপরীতমুখী বলের উদ্ভব হয় । বল দুটির একটিকে আমরা ক্রিয়া বলি , অপরটিকে বলি প্রতিক্রিয়া ।
স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছেন যে , এ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সর্বদা সমান ও বিপরীতমুখী । তিনি তার গতিবিষয়ক তৃতীয় সূত্রে বলেছেন ‘ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে ।
ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়া বল সবসময়ই দুটি ভিন্ন বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে কখনােই একই বস্তুর ওপর ক্রিয়া করে না । প্রতিক্রিয়া বলটি ততক্ষণই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত ক্রিয়া বলটি থাকবে । ক্রিয়া থেমে গেলে প্রতিক্রিয়াও থেমে যাবে । এ ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া বলদ্বয় বস্তুগুলাের স্থিরাবস্থায় বা গতিশীল অবস্থায় বা সাম্যাবস্থায় থাকা বা একে অপরের সংস্পর্শে থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভরশীল নয়, সর্বত্রই বর্তমান থাকে ।
ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়ার কয়েকটি উদাহরণ ক্রিকেটার যখন ব্যাট দিয়ে বলকে আঘাত করেন , তখন ব্যাটটি ক্রিকেট বলের ওপর একটি বল প্রয়ােগ করে । এটি ক্রিয়া । ক্রিকেট বলটিও ব্যাটের ওপর একটি বিপরীতমুখী বল প্রয়ােগ করে । এটি প্রতিক্রিয়া ।
টেবিল এবং টেবিলের ওপর বইয়ের অবস্থান : কোন বইকে টেবিলের ওপর রাখা হলে , বইয়ের ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল তথা বইটির ওজন খাড়া নিচের দিকে ক্রিয়া করে । বইটির ওপর যদি কেবলমাত্র তার ওজন কাজ করত অন্য কোনাে বল ক্রিয়া না করত , তাহলে বইটি সাম্যাবস্থায় থাকত না বরং টেবিলের মধ্য দিয়ে নিচে চলে যেত । কিন্তু তা হচ্ছে না । কারণ পথিমধ্যে টেবিল আছে এবং বইটি টেবিলের ওপর তার ওজনের সমান বল প্রয়ােগ করছে । ফলে টেবিলটিও একটি প্রতিক্রিয়া বলে বইকে উপরের দিকে ঠেলছে ।
সর্বশেষ
এই আর্টিকেলে নিউটনের প্রথম সূত্রের ব্যাখা , নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের ব্যাখ্যা এবং নিউটনের তৃতীয় সূত্রের ব্যাখ্যা ও বিবৃতি উদাহরণ সহ উপস্থাপন করা হয়েছে।
অবশ্যই পড়ুন-