বেগুন চাষ :বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ

আমরা আজকে আজকে আলোচনা করব বিভিন্ন জাতের বেগুন চাষ পদ্ধতি

বেগুন চাষ

বেগুন খুব পরিচিত একটি সবজি। দেশের প্রায় সব জেলাতেই কম বেশি বেগুনের চাষ হয়ে থাকে। সারা বছরই বেগুন চাষ করা যায়।বাংলাদেশ  ছাড়াও ভারত, চীন, জাপান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশসহ অনেক দেশে এর চাষ হয়ে থাকে বেগুনের গাছ প্রায় ৪০ থেকে ১৫০ সেমি লম্বা হয়। বেগুন পুষ্টিকর ও সুস্বাদু সবজি।

বেগুন চাষ পদ্ধতি
সঠিক পদ্ধতিতে বেগুনের চাষ করুন।

বেগুনের জাতসমুহ:

ইসলামপুরী, শিংনাথ, উত্তরা, নয়নকাজল, মুক্তকেশী, খটখটিয়া, তারাপুরী, নয়নতারা উল্লেখযোগ্য । বারমাসী কালো ও সাদা বর্ণের জাত (ডিম বেগুন) রয়েছে। বিদেশি জাতের মধ্যে ব্ল্যাক বিউটি, ফ্লোরিডা বিউটি, উল্লেখযোগ্য।

সকল জাতের বেগুন চাষ পদ্ধতি নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

বীজ বপন ও চারা উৎপাদন:

বেগুন চাষের জন্য চারা উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। শীতকালীন বেগুন চাষের জন্য কারণ মাসের মাঝামাঝি হতে আশ্বিন মাস এবং বর্ষাকালীন বেগুন চাষের জন্য চৈত্র মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা যায়। বালি, কমপোস্ট ও মাটি সমপরিমাণে মিশিয়ে বীজতলা তৈরি করতে হয়।

বীজ গজানোর ৮-১০ দিন পর চারা তুলে দ্বিতীয় বীজতলায় রোপণ করতে হয় ।

জমি নির্বাচন :

এঁটেলদোআঁশ মাটিতেও বেগুনের চাষ করা যায় । তবে পানি অপসারণের ভালো ব্যবস্থা থাকলে এঁটেল ও দোআঁশ মাটিতেও বেগুনের চাষ করা যায়।

জমি তৈরি:

জমি তৈরির জন্য ৪-৫ বার আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে তৈরি করতে।পেতে হলে জমি গভীরভাবে চাষ করতে ।

সার প্রয়োগের নিয়মাবলি

সারের নাম =শতক প্রতি

গোবর=৪০কেজি

ইউরিয়া=১কেজি

টিএসপি=৫০০ গ্রাম

এমওপি=৫০০গ্রাম

  1.  ইউরিয়া ছাড়া সব সার জমির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হয়। তবে গোবর জমি তৈরির প্রথম দিকে প্রয়োগ করাই উত্তম।
  2. ইউরিয়া সার চারা গজানোর ৮-১০ দিন পর থেকে১০-১২ দিন পর পর ২-৩ কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

চারা রোপণ:

এক মাস বয়সের সবল চারা কাঠির সাহায্যে তুলে নিতে হবে ।  চারাগাছের শিকড়ের যেন ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে । এর পর ৭৫ সেমি দূরত্বের সারিতে ৬০ সেমি দূরে দূরে চারা রোপন করতে হবে।

পরিচর্যা:

মাটিতে রসের অভাব হলে বা মাটি শুকিয়ে গেলে ১০-১৫ দিন পর পানি সেচ দিতে হবে। সেচের পর নিড়ানি দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে দিতে হবে। আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে ।

বেগুনের বালাই ব্যবস্থাপনা এ দেশে কমপক্ষে ১৬ প্রজাতির পোকা এবং একটি প্রজাতির মাকড় বেগুন ফসলের ক্ষতি করে থাকে । এর মধ্যে বেগুনের প্রধান শত্রু ডগাফল ছিদ্রকারী পোকা। এই পোকা বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্র করে। এছাড়া কাঁটালে পোকা বা ইপলাকনা বিট্‌ল, জাব পোকা, ছাতরা পোকা, বিছা পোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, থ্রিপস, কাটুই পোকা ইত্যাদি বেগুনের ক্ষতি করে থাকে।

আইপিএম পদ্ধতিতে এসব পোকা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে হবে।আক্রান্ত ডগা ও ফল সংগ্রহ করে ধ্বংস করে ফেলতে হবে এছাড়াও ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন নামক কীটনাশকের যে কোনো একটি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। এছাড়া নিম্নলিখিত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুনের বালাই দমন করা যায়।

ক) কলম চারা ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুনের উইল্টরোগ দমন করা যায় ।

খ)ফেরোমন ও মিষ্টিকুমড়ার ফাঁদ ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুন জাতীয় ফসলের মাছি পোকা দমন করা যায়।।।।।

গ)মুরগির পচনকৃত বিষ্ঠা ও সরিষার খৈল ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন সবজি যেমন- বেগুন, টমেটো, শশা,বাঁধাকপি ফসলের মাটি বাহিত রোগ দমন করা যায় ।

ঘ)সঠিক সময়ে আগাছা দমন ও মালচিং করলে ফলন বহুগুণে বৃদ্ধি পায় ।

ঙ) পোকা প্রতিরোধী জাত ব্যবহারের মাধ্যমে বেগুনের ডগা ও ফলের মাজরা পোকা দমন করা যায়। যেমন- বারি বেগুন-১ (উত্তরা), বারিবেগুন-৫ (নয়নতারা), বারিবেগুন-এ, বারিবেগুন-৭ ইত্যাদি পোকা প্রতিরোধী জাত।

চ)পোকার আক্রমণমুক্ত চারা ব্যবহার করতে হবে।

ছ) সুষম সার ব্যবহার করে ।

জ) শস্যপর্যায় অনুসরণ করে।

ফসল সংগ্রহ ও ফলনঃ

চারা রোপণের ৩০-৪০ দিনের মধ্যে গাছে ফুল আসে।ফল সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার পূর্বেই সংগ্রহ করতে হবে।  বেগুনের ফল বীজ শক্ত হওয়ার আগেই সংগ্রহ করতে হয়। অধিক পরিপক্ক হলে ফল সবুজাভ হলুদ অথবা তামাটে রং ধারণ করে এবং শাঁস শক্ত ও স্পঞ্জের মত হয়ে যায়।

অনেকে হাতের আঙুলের চাপ দিয়ে ফল সংগ্রহের উপযুক্ত কিনা তা নির্ধারণ করতে পারেন। এক্ষেত্রে দুই আঙুলের সাহায্যে চাপ দিলে যদি বসে যায় এবং চাপ তুলে নিলে পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে তবে বুঝতে হবে বেগুন কচি রয়েছে আর চাপ দিলে যদি নরম অনুভূত হয়, অথচ বসবে না এবং আঙ্গুলের ছাপ থাকে তাহলে বুঝতে হবে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়েছে।

বেশী কচি অবস্থায় ফল সিকি ভাগ সংগ্রহ করলে ফলের গুণ ভাল থাকে, তবে ফলন কম পাওয়া যায়। ফলের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে পরিপক্ক পর্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছানো পর্যন- বেগুন খাওয়ার উপযুক্ত থাকে। সাধারণতঃ ফুল ফোটার পর ফল পেতে গড়ে প্রায় ১ মাস সময় লাগে।

ফলনঃ জাত ভেদে সাধারণত প্রতি শতকে বা ৪০ বর্গমিটার জমিতে ১৭-১৪০ কেজি বেগুন উৎপন্ন হয়। উত্তরা বেগুন ২৫০ কেজি পর্যন্ত ফলন দেয়।

সতর্কতা:

বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়ুন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলুন। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোষাক পরিধান করুন।

ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করুন।

উত্তরা (বারি বেগুন ১)– বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত একটি উন্নত জাত। শীতকাল এ বেগুন চাষের উপযুক্ত সময়। গাছের পাতা ও কাণ্ড হালকা বেগুনী এবং পাতার শিরাগুলো গাঢ় বেগুনী হয়। পাতার নীচের দিকে সামান্য নরম কাটা দেখা যায়।

গাছ খাটো আকৃতির ও ছড়ানো হয়ে থাকে। প্রতি গুচেছ ৫-৬টি ফল ধরে। ফলের রং বেগুনী এবং ১৮-২০ সেমি. লম্বা। ফলের ত্বক খুব পাতলা, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু।

হেক্টর প্রতি গড়ে ৬৪ টন ফলন পাওয়া যায়। এ জাতটি ‘ঢলে পড়া’ নামক রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। গাছ প্রতি গড়ে ১৯৫টি ফল ধরে।

খটখটিয়া– শীতকালে চাষ উপযোগী জাত। গাছ উচ্চতায় ও বিস্তৃতিতে মাঝারি, পাতা মাঝারী চওড়া। ফল দন্ডাকার ও কালচে বেগুনী। ফল লম্বায় ১৬-২০ সেমি. ও বেড়ে ৩.৫০-৫.৫০ সেমি.। প্রতিটি ফলের ওজন ১০০-১২৫ গ্রাম। গড় ফলন ২৯ টন/হেক্টর

ইসলামপুরী– এটি শীতকালীন জাত। এ জাতের গাছে ও ফলে কাঁটা নেই। গাছের উচ্চতা মাঝারি ধরনের ও শাখা প্রশাখাযুক্ত। পাতার রং বেগুনী সবুজ। ফল গোলাকার, কচি অবস্থায় গাঢ় বেগুনী, পরিপক্ক অবস্থায় সবুজাভ বেগুনী। তবে কোন কোন সময় ত্বকে সবুজ বর্ণের ছোপ থাকতে পারে। ফলের শাঁস মোলায়েম ও সুস্বাদু, বীজের সংখ্যা কম। প্রতিটি ফলের ওজন ২০০-৪০০ গ্রাম। গড়ন ফলন ৩৬ টন/হেক্টর। গাছ প্রতি গড় ফল ধরার সংখ্যা ১৩টি।

নয়ন কাজল –প্রধানত শীতকালীন জাত। গাছের উচ্চতা মাঝারী ধরনের ও শাখা প্রশাখা যুক্ত। ফল বেলুনাকৃতি, লম্বা ২০ সেমি. পর্যন্ত হতে পারে, ফলের রং হালকা সবুজ, বোঁটার কাছে হালকা বেগুনী। চোখের কাজলের মত আচড় আছে।

সম্ভবতঃ এ কারণে জাতটির নাম নয়ন কাজল। একটি অধিক ফলনশীল জাত, ফলে বীজের পরিমাণ কম, শাঁস মোলায়েম এবং খেতে সুস্বাদু। প্রতি ফলের ওজন ৩০০-৬০০ গ্রাম।

শিংনাথ– একটি বারমাসী জাত। গাছ বেশ উঁচু, পাশেও অধিক, শাখা প্রশাখার সংখ্যা প্রচুর। পাতা সরু ধরনের। এর ফল সরু, লম্বায় প্রায় ৩০ সেমি. ও বেগুনী রংয়ের। বেগুনের মধ্যে বীজ মাঝারি সংখ্যক, খেতে সুস্বাদু।

এই জাতের বেগুনের মধ্যে কতকগুলি উপজাত আছে, যেগুলি ফলের আকার, আকৃতি, বর্ণের দিক থেকে পরষ্পর থেকে ভিন্ন। প্রতিটি ফলের ওজন ৭৫-১৫০ গ্রাম। প্রতিটি গাছে গড়ে ৩৯ টি বেগুন ধরে এবং গড় ফলন ৩০ টন/হেক্টর।

ডিম বেগুন- একটি উচ্চ ফলনশীল বারমাসী জাত। এ জাতে পোকার উপদ্রব খুব কম হয়। ফল ধবধবে সাদা, আকৃতিতে প্রায় ডিমের মত। প্রতিটি ফলের ওজন ৪০-৬০ গ্রাম।

আরও জানুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *