মৌমাছি চাষ ও মধু উৎপাদন

আমারা আজকের আর্টিকেলে জানব  মৌমাছি চাষ ও মধু উৎপাদন প্রক্রিয়া।

মৌমাছি চাষ ও মধু উৎপাদন :(Apiculture and Honey Production):

মৌমাছি চাষ

মৌমাছি চাষ ও মধু সংগ্রহ

মৌমাছি :

মৌমাছি (Apis) একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ। মৌমাছির বাসা থেকে মানুষের মধু সংগ্রহ করা নতুন কিছু নয়। কিন্তু মৌমাছিকে চাষ করার কৌশল অপেক্ষীকৃত নতুন। ইউরোপীয় মৌমাছির প্রজাতি (Apis mellifera) বহুকাল আগে থেকে মানুষের বশীভূত হয়েছে।

বাংলাদেশে মৌমাছি চাষ খাতটি কুটির শিল্প হিসেবে গণ্য। এতে স্বল্প মূলধনে অনেক বেশি লাভ হয়। মধুর জন্য যেসব মৌমাছি চাষ করা হয় তাদের মধ্যে এপিস সেরানা(Apis cerena) বিখ্যাত। এই মৌমাছি লোকালয়েই বাসা বাঁধতে পছন্দ করে। কারণ জঙ্গলে বাসকারী অপর প্রজাতি বা দৈত্য মৌমাছি (Apis dorsata) cerana প্রজাতিকে আক্রমণ করে এবং মধু লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। তবে লোকালয়ে থাকে বলে cerana প্রজাতিটি আমাদের দেশের জন্য বিশেষ উপযোগী। গাছের কোটর, ভেন্টিলেটর, ঘরের ছায়াময় ও নির্জন স্থানে বাসা বাঁধে। এ মৌমাছি একাধিক চাক তৈরি করে উপনিবেশ গড়ে তোলে ।

মৌমাছি চাষ:

মৌমাছি চাষের উত্তম সময়:মৌমাছি চাষ সাধারণত আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে এবং ভালো আবহাওয়া থাকলে একমাসেই ৪ থেকে ৫ বার টান হয়, আর প্রতিবার একটি বাক্স থেকে এক টিন করে মধু পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে মৌমাছি চাষের উত্তম সময়সীমা মাঘ-চৈত্র। তবে বেশি যত্নবান হলে বছরের অন্য সময়ও মৌমাছি পালন করা সম্ভব।

মৌমাছি চাষ করার নিয়ম
Bee box

মৌ-বাক্স স্থাপনের দূরত্ব: ব্যবসায়ের ভিত্তিতে চাষ করার জন্য বাগানে ২.৫ মিটার দূরত্বের সারিতে ১.৫-১.৮ মিটার অন্তর মৌ-বাক্স স্থাপন করা যায়। তবে পাশাপাশি অবস্থায়ও মৌ-বাক্স রাখা যায়। পাশাপাশিভাবে স্থাপনের ৪-৫ দিন পর্যন্ত মৌ-বাক্সগুলোকে বিপরীতমুখী অবস্থায় রাখা প্রয়োজন। সঠিক কৌশল জানা থাকলে একটা মৌ-বাক্স উপরে আরেকটা মৌ-বাক্স স্থাপন করা যায়। তবে পরিচর্যাও কাজের সুবিধার জন্য ১.৮ মিটার অন্তর অন্তর রাখাই উত্তম।

মোমাছির বাক্স কোথায় পাওয়া যায়?

মৌমাছিসহ মৌ-বাক্স পাওয়ার স্থান ও উৎস:

একটি বাক্সে সাধারণতঃ ২ থেকে ৪ লক্ষ পর্যন্ত মৌমাছি থাকতে পারে এবং ৪-৫ কেজি ভালো মধু পাওয়া যায়।প্রতিটি বাক্সের ভিতরে ৯ টি বা ১০টি ট্রে থাকে, শ্রমিক মৌমাছির সংখ্যা বেশি থাকলেও রানী মৌমাছির সংখ্যা সেখানে একটিই থাকে। আর পুরুষ মৌমাছিরা এই ডিমগুলি নষ্ট করে দেয় বলে এবং অনেকসময় এই মৌমাছি গুলি মধু খেয়ে নেয় বলে সেগুলিকে বাক্সে বেশি রাখা হয় না।মৌমাছি চাষ করার জন্যে কয়েকটি কাঠের বাক্সের প্রয়োজন, যেহেতু মৌমাছির বংশবৃদ্ধি খুব তাড়াতাড়ি হয়, তাই ২টি বাক্স থেকে মৌমাছি চাষ শুরু করলে কয়েকমাসের মধ্যেই সেটা ৬ টা বা ৭ টা বাক্স হয়ে যাবে , তাই যদি সিরিয়াসলি এই ব্যবসা করতে চাও প্রথমেই ১ টি বা দুটি বাক্স না কিনে ৮ ৯ টি বাক্স কিনে নেওয়াই ভালো হবে।

বাংলাদেশ সরকারের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কীটতত্ত্ব বিভাগ, বরিশাল জেলার কলসকাটির যতীন্দ্র স্মৃতি আশ্রম, সিলেটের, জান্ডিয়ার নিকটস্থ খাসিয়া পরি, ঢাকার মোহাম্মদপুরস্থ বাংলাদেশ এপিকালচার ইনস্টিটিউটে উন্নতমানের বিক্রয়যোগ্য যা নমুনা মৌ-বাক্স পাওয়া যেতে পারে। কৃষি বিভাগে বর্তমানে জেলা পর্যায়ে মৌমাছিসহ মৌ-বাক্স বা মৌমাছি চাষ সম্পর্কিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

মৌমাছির চাষের স্থান: নির্জন, ধোঁয়া ও গ্যাসমুক্ত, উঁচু এবং যার অনতিদূরে ফুল গাছ আছে, সেসব জায়গা মৌমাছি চাষের জন্য উত্তম। তবে এসব স্থান এমন উন্মুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় যেন মৌ-বাক্স স্থাপন করলে এর উপর সকালের সূর্যকিরণ পড়ে। বসতবাড়ির উঠানে, ঘরের চারপাশে, দরজার পাশে, বাগানে গাছের নিচে, পুকুর পাড়ে ছায়াযুক্ত স্থানে মৌ-বাক্স স্থাপন করা যায়। এক মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশে Apis cerana প্রজাতির মৌমাছি ৫-১০টি পর্যন্ত চাক তৈরি করে থাকে। তবে আবাসস্থলের আয়তনের ওপরেই এদের চাকের সংখ্যা নির্ভর করে। সেরানা প্রজাতি গাছের কোটর, আলমারি, কলসি, সিন্দুক, ছাদের কার্নিশের নিচে ও ভেন্টিলেটরের মধ্যে চাক বাঁধে

রাণী মৌমাছি সংগ্রহঃ

মৌমাছির কলোনির খোঁজ পেলে প্রথমেই সনাক্ত করতে হবে এটি Apis creana প্রজাতির কিনা। যদি তা উক্ত প্রজাতির হয়, তবে প্রয়োজনীয় উপকরণসহ যথাস্থানে যেতে হবে। এক্ষেত্রে মৌ-বাক্সের নিচের পাটাতন, ফ্রেমসহ বাচ্চা ঘর এবং ভিতরকার ঢাকনা সাথে নিলেই চলবে। প্রজাতি শনাক্ত করার সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা দরকার।

মৌমাছি সংগ্রহের ধাপঃ-

 ১. সেরানা প্রজাতি হলে দুপুরের কড়া রোদে এবং মেঘলা দিনে মৌমাছির মেজাজ উগ্র হবে ।

২. মেঘমুক্ত সকাল এবং বিকেল মৌমাছি ধরার উপযুক্ত সময়।

৩. প্রথমে নির্দিষ্ট পোশাক পরে নিয়ে ধোঁয়া প্রয়োগ করে প্রহরী মৌমাছিদের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে।

৪. কলোনির ভিতর থেকে যাতে নিরাপদে চাক বের করে নেয়া যায় তার জন্য রাস্তা তৈরি করতে। এ সময় কলোনির ভিতরে সামান্য পরিমাণ ধোঁয়া প্রয়োগ করলে মৌমাছিরা শান্ত হয়ে পড়বে।

৬.গাছের গর্তে বাসা থাকলে একটি কাঠি ঢুকিয়ে চাকের অবস্থান নির্ণয় করে চাকু দিয়ে ছিদ্র করতে হবে ।

৭. এক হাতে চাক ধরে অন্য হাতে ছুরি দিয়ে চাকের গোড়া কেটে চাক বের করতে হয়।

৮. যে কোনো চাক কেটে চাকের ওয়াক্স মথ আক্রান্ত পচা অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে।

পুরুষ মৌমাছি চাষ ও চাক বাধাঃ

১. কলোনিতে যদি ৩-৪টি পুরুষ মৌমাছি না থাকে, তাহলে পুরুষ কোষযুক্ত চাকের অংশ কাটা যাবে না কারণ রাণী মৌমাছি মারা গেলে নতুন রাণী তৈরি করা যায়, কিন্তু পুরুষ মৌমাছি তৈরি করা বেশ কঠিন।

২.চাক কেটে বাইরে আনার পর বাচ্চা ঘরের ফ্রেম বের করে ফ্রেমের ভিতরের আয়তনের সমান আয়তনবিশিষ্ট। কেটে নিয়ে ফ্রেমসহ চাককে উপুড় করে ধরে কলার আঁশ দিয়ে দু’পাশ বেঁধে নিতে হবে ।

৩. চাক ফ্রেমের সাথে বাঁধতে হবে যাতে বাক্সে বসালে ফ্রেমের উপরের বাহু থেকে চাকটি নিচে ঝুলতে থাকে।

৪. চাক বাঁধার পর ফ্রেমটিকে চাকসহ মৌ-বাক্সে স্থাপন করতে হয়।

মৌবাক্সে মৌ-মাছি প্রবেশ করানোর ধাপ:

উপযুক্ত পদ্ধতিতে কলোনির সবগুলো চাককে মৌ-বাক্সের ফ্রেমের সাথে বেঁধে বাক্সে ঢোকাতে হবে। যেমন

১.চাকগুলোকে বাক্সে ঢোকাবার পর রাণী মৌমাছিকে খুঁজে বের করতে হয় ।

২. এ সময় রাণী মৌমাছি ঝাঁক হয়ে বসে থাকা মৌমাছিদের উপরে ঘুরতে থাকে। এ সময় রাণী মৌমাছি শেষ চাক অথবা শেষ চাকের আগেরটাতেও থাকতে পারে ।

৪. রাণী মৌমাছিকে পেয়ে এক হাতে ফ্রেম নিয়ে অন্য হাতে রাণী মৌমাছি ধরে খাঁচায় ঢুকিয়ে দিতে হয় ।

৫.রাণীসহ খাঁচা মৌ-বাক্সের গেটের সামনে রাখতে হবে। পরে ঝাঁকে বসে থাকা মৌমাছি বাক্সে ঢুকাতে হয় ।

৬. সব মৌমাছি বাক্সে ঢুকে গেলে রাণীকে বাক্সের ভিতর মুক্ত করে মৌ-বাক্সে মৌমাছি আটক তারজালবিশিষ্ট গেট লাগিয়ে বাক্সটি বেঁধে ফেলতে হবে।

৭. কোনো কারণে রাণীকে প্রথমে খুঁজে না পেলে অন্যান্য মৌমাছিকে বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হবে।

৮. কর্মী মৌমাছিদেরকে হাত দিয়ে বাক্সে ঢোকাবার সময় রাণী মৌমাছিটিও মৌ বাক্সে ঢুকে যেতে পারে।

উপযুক্ত স্থানে মৌ-বাক্স স্থাপন (Placing the Bee box in a suitable site):

সবগুলো মৌমাছি বাক্সে ঢুকে গেলে প্রবেশ পথে তারজাল বসিয়ে মৌমাছিদের যাওয়া-আসা বন্ধ করতে হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রবেশ পথ দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করতে পারে । বাক্সের ভিতর সবগুলো ফ্রেম বসিয়ে দিতে হয়, এমনকি খালি ফ্রেমও বাইরে রাখা যাবে না। কারণ, ফ্রেমসহ নিচের পাটাতন ও মৌ বাক্সকে শক্ত করে বেঁধে নিতে হয়, যাতে কোনো অংশ নড়াচড়া না করে। গেটটি সামনের দিকে মুখ করে কোনোরূপ ঝাঁকুনি না লাগিয়ে বেশ সাবধানতার সাথে মৌ বাক্সকে বাসায় নিয়ে আসতে হয়।

মৌ-বাক্সকে স্থাপনের কৌশল :

মৌ-বাক্সকে বাসায় নিয়ে আসার পর ছায়াযুক্ত ঠাণ্ডা জায়গায় কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। মৌ-বাক্সকে তক্তার মাঝখানে ফাঁকযুক্ত ৪৫ সেমি উঁচু ছোট স্ট্যান্ডের উপর বসাতে হয়। মৌ-বাক্সকে উদ্যানের পূর্ব কিংবা পশ্চিমমুখী করে বসালে সূর্যের আলো বাক্সে প্রবেশ করে চাকের ক্ষতি করতে পারে। আর উত্তর অথবা দক্ষিণমুখী করে বসালে বৃষ্টিপাত চাকের ক্ষতি করে । তাই মৌ-বাক্সকে উদ্যানের উত্তর-পূর্বমুখী করে বসানোই সর্বাপেক্ষা উত্তম ।

বাক্সের খুঁটি বা পায়া বেয়ে পিঁপড়া উঠে মৌ-বাক্স আক্রমণ করতে পারে, তাই প্রতিটি খুঁটি বা পায়ার নিচে একটি করে পানিপূর্ণ পাত্র স্থাপন করা দরকার। এতে মৌমাছিরা পিঁপড়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। এরপর বাক্সের উপর মৌ বাক্সের টুপির অংশ সংযুক্ত করতে হয়।

মৌ-বাক্স রক্ষণাবেক্ষণ:

মৌমাছি চাষ করার জন্য মৌ বাক্স রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যাবশ্যক।

প্রাকৃতিক কলোনি ধরে আনার ২-৩ দিনের মধ্যেই মৌমাছিরা ফ্রেমের সাথে মোম দ্বারা চাককে সংযুক্ত করে ফেলে ।

পাটাতন পরিষ্কার করা : মৌ-বাক্সের কাছে স্ট্যান্ড স্থাপন করে নিচের পাটাতন পরিষ্কার করতে হয় ।

পানির পাত্র পরিষ্কার করা : মৌ-বাক্সের নিচে খুঁটির তলায় পানির পাত্র পরিষ্কার রাখা দরকার।

কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ : প্রাকৃতিক কলোনি ধরে আনার পর কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। কারণ নতুন জায়গায় আসার পর প্রাকৃতিক খাদ্যের খোঁজ নেওয়া কষ্টসাধ্য। তাছাড়া প্রাকৃতিক কলোনি ধরার সময় এদের চাক থেকে সজ্জিত মধু আহরণ করে ফেলা হয়।

একাধারে বৃষ্টি হলে মৌমাছিরা বাসার বাইরে বের হতে পারে না। এ সময় এরা চাকের সঞ্চিত মধু পান করেই বেঁচে থাকে। এ সময় যদি চাকে মধু না থাকে, তাহলে কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়।

অধিক শীতের সময় মৌমাছিরা বাসার বাইরে বের হতে চায় না। এরূপ অবস্থায় মৌমাছিরা চাকের সঞ্চিত মধু পান করে নিঃশেষ করে ফেলে। তাই এ সময়েও কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। কৃত্রিম খাদ্য হিসেবে খেজুরের গুড়, চিনির সিরাপ ও মধু সরবরাহ করা যেতে পারে। খেজুরের রস ও গুড় খোলা অবস্থায় সরবরাহ করলে মৌমাছিদের ঘন ঘন মল ত্যাগের প্রবণতা দেখা দেয়। তাই এসব খাদ্য সরবরাহ না করাই শ্রেয়। ফলে চিনির সিরাপই কৃত্রিম খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করা শ্রেয়।

মৌমাছির কৃত্রিম খাদ্যর উপাদানসমূহ:

পানি=১কেজি

চিনি=১ কেজি ২৫০ গ্রাম

টারটারিক অ্যাসিড=৭সিসি

মৌমাছির শত্রু (Pest of Honey bees):

প্রাকৃতিকভাবে বেশ কয়েক প্রকার প্রাণী মৌমাছির শত্রু। মৌমাছির শত্রুর মধ্যে প্রধান—

  1. গুবরে পোকা, বড় ওয়াক্স মথ, ছোট ওয়াক্স মথ
  2. লাল ও হলদে বোলতা, লাল ছোট পিঁপড়া, বড় কালো পিঁপড়া ।
  3. চড়ুই পাখি, সুই চোরা পাখি, কাক, টিকটিকি, মাকড়সা, দস্যু মাছি।
  4. রক্তচোষা (Chamaeleon), উঁই পোকা, বিছা পোকা।
  5. ব্যাঙ, মোরগ-মুরগি, ইঁদুর।

মৌমাছি চাষের মাধ্যমে মধু উৎপাদন

বড় ওয়াক্স মথ

বড় ওয়াক্স মথ(Galleria mellonella) বা মোম পোকা : ওয়াক্স মথ মৌচাকের বড় শত্রু । দুর্বল কলোনি, পুরোনো চাক, অপরিষ্কার মৌ-বাক্সে এই পোকার আক্রমণ লক্ষ করা যায়। তবে Apis dorsata & Apis florea এর মৌচাকেই বেশি আক্রমণ করে থাকে। কারণ, এ দুটি প্রজাতি উন্মুক্ত স্থানে চাক বাঁধে বলে বড় ওয়াক্স পোকা যে কোন দিক থেকে প্রবেশ করার সুযোগ পায় ।

আক্রমণের লক্ষণঃ
  1. বিশেষ করে রাতে ওয়াক্স মথ পোকা মৌচাকে আশ্রয় নেয়।
  2. কোষের বাইরের মুখে গুচ্ছাকারে আক্রমণকারী মথ পোকা ডিম পাড়ে।
  3. আক্রান্ত চাকের কোষের মুখে পাতলা আঁশের জাল দেখা যায় ।
  4. শূককীট মৌচাকের মোম খেয়ে চাকের কোষ আঁশযুক্ত করে দেয় । ৫. আক্রান্ত চাকে রাণী ডিম পাড়ে না, শ্রমিক কাজ করে না।
  5. মৌচাকে ডিম, শূককীট ও মুককীটের সংখ্যা কমে যায়।
  6. মৌমাছিরা অলস ও শান্ত হয়ে পড়ে এবং সঞ্চিত মধু খেয়ে শেষ করে ফেলে।
  7. আক্রান্ত চাকে রাণি ডিম পাড়ে না,শ্রমিক কাজ করে না।
  8. অবশেষে মৌমাছিরা বাক্স ছেড়ে পালিয়ে যায়।
প্রতিকার ব্যবস্থাঃ
  1. ভিতরের ঢাকনির জালের উপর ৪-৫টি প্যারাডাইক্লোরোবেনজিন বড়ি রাখা ।
  2. আক্রান্ত চাক সরিয়ে ফেলা ও পুরোনো চাককে রোদে শুকোনো।
  3. পুরোনো রাণী নতুন রাণী দ্বারা প্রতিস্থাপন করা।
  4. অতিরিক্ত মধুকক্ষ সরিয়ে ফেলা।
  5. মৌ-বাক্সের ভিতরে অযথা খালি জায়গা না রাখা ।
  6. মৌ-বাক্সের গর্ত ও ফাটল মোম গালা দিয়ে ভরাট করা ।
  7. পুরনো চাক রোদে শুকিয়ে অথবা  সাল্ফার পুরিয়ে ধোঁয়া কেক প্রবেশ করানো।
  8. নিয়মিতভাবে মৌচাক পর্যবেক্ষণ।

লাল বোলতাঃ

অনেক সময় ৫০-১০০টি এ জাতীয় বোলতা একসাথে এসে দুর্বল কলোনির মৌ-বাক্সে ঢুকে পড়ে। ফলে মৌমাছি  পালিয়ে যায়।

প্রতিকার ব্যবস্থাঃ

  • বোলতা দেখলেই মেরে ফেলা।
  • দুৰ্বল মৌমাছি কলোনিকে সংযুক্তকরণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা।
  • নিয়মিতভাবে মৌ-বাক্স পর্যবেক্ষণ করা।
  • মৌমাছিদের প্রবেশ পথে, মৌ-বাক্সে বোলতা দেখলে মেরে ফেলা।

লাল পিঁপড়া

এক ধরনের ছোট লাল পিঁপড়া মৌমাছির কলোনি আক্রমণ করে থাকে। এ জাতীয় পিঁপড়া কলোনিতে ঢুকে বাসা বাঁধে।

 

আক্রমণ পদ্ধতিঃ

  • বেশ কিছু পিঁপড়া একসাথে যে কোনো একটি মৌমাছিকে ধরে বাসায় নিয়ে যায় ।
  • মৌমাছি কলোনিকে আক্রমণ করে এবং চাকে রাণীর ডিম নষ্ট করে দেয়।
  • পিঁপড়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে মৌমাছির সম্পূর্ণ কলোনি পিঁপড়ার দখলে চলেআসে। ফলে মৌমাছিরা গৃহত্যাগ করে ।
  • পিঁপড়ারা চাকের সঞ্চিত মধুর ক্ষতি করে ।

প্রতিকার ব্যবস্থাঃ

  • নিয়মিত মৌ-বাক্স পরিষ্কার করা।
  • বাগান পরিষ্কার করা, পিঁপড়ার বাসা ধ্বংস করা।
  • পানির পাত্রে সব সময় পানি রাখা।
  • মৌ-বাক্সের স্ট্যান্ডগুলোতে আলকাতরা দেওয়া ।

মধু উৎপাদন ও আহরণ (Production and Collection of Honey):

মৌমাছি চাষ ও মধু উৎপাদন –

  1. দূত বা খবরদাতা মৌমাছি বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে নাচের মাধ্যমে শ্রমিক মৌমাছিদের মধু প্রাপ্তির স্থান নির্দেশ করে।
  2. পরে শ্রমিক মৌমাছিরা ঐ জায়গায় পৌঁছে ফুলে বিচরণ করে ও মধু বা নেকটার (nectar) আহরণ করে। ফুলের এই মধুকে নেকটার বলা হয়।
  3. নেকটার মৌমাছির লালার সাথে মিশ্রিত হয়ে মধুতে পরিণত হয়।
  4. মৌমাছি মধু থলির মাধ্যমে এই মধু চাকে নিয়ে আসে এবং কোষে উপড়িয়ে দিয়ে ডানার সাহায্যে বাতাস করতে থাকে।ফলে মধুর জলীয় অংশ বাষ্পে পরিণত হয়ে উড়ে গিয়ে মধুর ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়।
  5. পরে শ্রমিক মৌমাছি পাতলা মোমের আবরণ তৈরি করে কোষের মুখ বন্ধ করে রাখে।

প্রকৃতিক মধু সামান্য হলুদ, লাল বা বাদামি হয়ে থাকে। শ্রমিক মৌমাছি মৌ-বাক্সের সুপার চেম্বারেই মধু জমা রাখে। কিন্তু প্রকৃতিতে যেসব মৌচাক দেখা যায়, তাতে শ্রমিক মৌমাছি চাকের নানা স্থানে মধু জমা রাখে।

মধু আহরণ:

বসন্তে প্রকৃতি ফুলে সুশোভিত হলে মধু সংগ্রহ করা যায়। এদেশে মার্চ-জুন এই চারমাস প্রকৃতিতে প্রচুর মধু থাকে। এ সময়ে মৌমাছিরা নতুন রাণী তৈরি করে ঝাঁক বেঁধে অন্যত্র চলে যেতে চায়। ঝাঁক বেঁধে যেন চলে যেতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বসন্তকালে কলোনিতে শ্রমিক মৌমাছির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে সন্ধ্যাবেলায় মৌ-বাক্সে স্থানাভাব দেখা দিলে কলোনিতে অতিরিক মধুকক্ষ সংযোজন করতে হয়। প্রয়োজনবোধে প্রতি দশদিন অন্তর মধু নিষ্কাশন করতে হয়। শ্রমিক মৌমাছিরা যাতে ইচ্ছেমতো কলোনিতে মধু সঞ্চয় করে রাখতে পারে, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

মধুকক্ষে মৌমাছিরা সহজে চাক তৈরি করতে চায় না বলে বাচ্চাকক্ষের চাক থেকে ডিম, শূককীট ও মুককীট সরিয়ে মধুকক্ষে বেঁধে দিতে হয়। এ কাজের জন্য পুরুষ কোষযুক্ত চাকই অধিকতর শ্রেয়।

মৌমাছির মধুর গুরুত্ব:

রোগব্যাধি নিরাময়ে মধুর ব্যবহার অতি সুপ্রাচীন। মধুতে যে গ্লুকোজ থাকে তা মধু সেবনের পরই সরাসরি রক্ত দ্বারা শোষিত হয়ে দেহে তাৎক্ষণিক শক্তি যোগায়। মধু রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরাসরি দেহকোষে শক্তি উৎপন্ন করে । পরাগায়নগত গুরুত্ব: মৌমাছি ফুলে ফুলে ঘুরে ফলে এদের পায়ে পরাগরেণু লেগে থাকে অন্য ফুলের গর্ভদণ্ডে পতিত হয়ে ফসলের পরাগায়ণ ঘটায়। ফুলে দানা-বীজ তৈরি হয়। পরাগায়ণ ব্যতীত সফল দানাবীজ তৈরি হয় না। পরপরাগায়িত সকল ফুলের ক্ষেত্রেই একথা প্রযোজ্য। প্রাকৃতিক পরাগায়নের পাশাপাশি কৃত্রিম পরাগায়ণ ফসলের ফলন বাড়ায়। সরিষা গোত্রীয় ফসলে মৌমাছি চাক বসালে ৩০% পর্যন্ত ফলন বাড়তে পারে ।

পুষ্টির গুরুত্ব :

মধুতে উপস্থিত রিবোফ্লাভিন (riboflavin) ও নিকোটিনিক অ্যাসিড (nicotinic acid) দেহের সুস্থতা ও সজীবতা রক্ষা করে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। মধুতে প্রোটিন রয়েছে তা আমাদের দৈহিক গঠন বৃদ্ধি ও ক্ষয়পূরণের জন্য অত্যাবশ্যক । ভিটামিন-বি মধুতে পাওয়া যায়, তা স্নায়ুমণ্ডলীকে সতেজ রাখে।

চিকিৎসাক্ষেত্রগত গুরুত্ব:

মধুর খাদ্যপ্রাণ মানুষের বেরিবেরি, পেলেগ্রা প্রভৃতি মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। মধুর ক্যালসিয়াম ফসফরাস শরীরের হাড় গঠনের জন্য প্রয়োজনীয়। ম্যাগনেসিয়াম দেহের এনজাইম বা উৎসেচক অনুঘটকের এবং বিশেষ উপাদান। মধুতে বিদ্যমান তামা ও লোহাজাতীয় খনিজ পদার্থ রক্তের লোহিত কণিকা তৈরি করে, দেহের জন্য শক্তি যোগায়। মধুতে ফরমিক অ্যাসিড, অ্যাসিটিক অ্যাসিড, সাইট্রিক অ্যাসিড ও ল্যাকটিক অ্যাসিড মানবদেহের রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। আয়ুর্বেদীয় এবং ইউনানী পদ্ধতিতে তৈরি বহু ওষুধেই মধু ব্যবহার করা হয়ে থাকে। শ্বাসকষ্ট, রক্ত পরিশোধক, ঠাণ্ডা লাগা, সর্দি কাশি প্রতিরোধ, জ্বর নিরাময়ে, ক্ষত, চক্ষু রোগ, জিহ্বার ঘা, গলার ঘা এবং আগুনে পোড়া ঘা দূর করার জন্য মধু ব্যবহৃত হয়। গ্যাস্ট্রিক বা গ্যাস্ট্রিক আলসারে আক্রান্ত রোগীর জন্যও নিয়মিতভাবে মধু সেবন ফলদায়ক। বুক ও পেটের ব্যথা উপশমে মধু উপকারী।

উপজাত দ্রব্য: মৌমাছি চাকের মধ্যভাগে অথবা পাশের দিকে মধু, মোম ও পরাগরেণু মিশিয়ে যে মৌ-রুটি তৈরি করে, তা ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় উপকারী বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া হৃৎপিণ্ডের যে কোনো রোগে মধু বিশেষভাবে উপকারী।

মধুর বর্তমানে সরাসরি খাদ্যপথ্য ব্যবহার, খাদ্য শিল্প ব্যবহার, অন্যান্য শিল্প ব্যবহার, ঔষুধ উপকরণ ব্যবহার, এন্টিবায়োটিক ব্যবহার প্রভৃতি দিনে দিনে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছে।

মৌমাছি চাষ ও মধু উৎপাদন সম্পর্কিত আর্টিকেলটি এখানেই শেষ হলো।

You Might Also Like:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *