স্যাটেলাইট কি ? বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সম্পর্কিত তথ্য
স্যাটেলাইট কি, স্যাটেলাইট কাকে বলে, স্যাটেলাইট এর কাজ কি, স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে, স্যাটেলাইটের সুবিধা কি কি এসব বিষয়ে আজকের আর্টিকেলে আমরা জানব।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট
তীব্র আগুনের হল্কা ছুটিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে মহাকাশের দিকে ডানা মেলে ছুটে চলল বাংলাদেশের পতাকা শোভিত প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় মুহূর্ত।
এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির সক্ষমতা, উন্নতি, সাফল্য, গৌরব ও দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়। বাংলাদেশ প্রবেশ করে মহাকাশ যুগে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবের ৫৭ তম সদস্যের মর্যাদা লাভ করে।
স্যাটেলাইট কি এবং স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে?
স্যাটেলাইট হলো মহাকাশে উৎক্ষেপিত বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত কৃত্রিম উপগ্রহ। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার খবর নিমেষেই পেয়ে যাই।
স্যাটেলাইটকে রকেট বা স্পেস শাটলের কার্গো বে এর মাধ্যমে কক্ষপথে পাঠানো হয়। পাঠানোর সময় রকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয় ইনার্শিয়াল গাইডেন্স সিস্টেম (আইজিএস) মেকানিজম।
পৃথিবীর অভিকর্ষ পার হতে রকেটটিকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার ৩৯ মাইল ত্বরণে ছুটতে হয়। স্যাটেলাইট স্থাপনের সময় কক্ষীয় গতি ও তার জড়তার ওপর পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের যে প্রভাব রয়েছে, এর জন্য সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারলে স্যাটেলাইট এ অভিকর্ষের টানে ফের ভূ-পৃষ্ঠে চলে আসতে পারে।
এ জন্য স্যাটেলাইটকে ১৫০ মাইল উচ্চতাবিশিষ্ট কক্ষপথে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ হাজার মাইল গতিতে পরিভ্রমণ করানো হয়।
পৃথিবী থেকে ২২ হাজার ২২৩ মাইল ওপরে স্থাপিত স্যাটেলাইট ঘণ্টায় ৭০০ মাইল বেগে পৃথিবীকে আবর্তন করে। পৃথিবীর সঙ্গে স্যাটেলাইটও ২৪ ঘণ্টা ঘোরে।
তবে, ভূ স্থির বা জিওস্টেশনারি উপগ্রহগুলো এক জায়গাতেই থাকে। এগুলো আবহাওয়া ও যোগাযোগ সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হয়।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি ঠিক এ রকমই একটি স্যাটেলাইট।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সম্পর্কিত তথ্য
বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি ১১৯.১° পূর্ব দ্রাঘ্রিমার ভূ-স্থির স্লটে স্থাপিত হবে। এটিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
ফ্রান্সের থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস কর্তৃক নকশা তৈরি করা হয়েছে এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিমালিকানাধীন মহাকাশযান সংস্থা স্পেস এক্স থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০ টি কেইউ এবং টিসি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার বহন করবে এবং এটির আয়ুষ্কাল ১৫ বছর।
স্যাটেলাইটের বাইরের অংশে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকার রঙের নকশার ওপর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু-১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে।
বিএস-১ উপগ্রহটি ২৬ টি কেইউ ব্যান্ড এবং ১৪ টি টিসি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডারে সজ্জিত হয়েছে ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমার কক্ষপথে অবস্থান থেকে। কেইউ ব্যান্ডের আওতায় রয়েছে বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমাসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সম্ভাবনা: বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড স্যাটেলাইট ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছে। পুঁজিবাজারে এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার পরিকল্পনা চলছে।
বর্তমানে বিদেশি স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বাংলাদেশকে গুনতে হয় ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। নিজস্ব উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পর বাংলাদেশ সেই নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটে রয়েছে মোট ৪০ টি ট্রান্সপন্ডার। এর ২০ টি বাংলাদেশের ব্যবহারের জন্য রাখা হয় এবং বাকি ২০ টি ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে নেপাল, ও ফিলিপিন্সের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই আগ্রহ দেখিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অবস্থান ইন্দোনেশিয়ার একদম ওপরে। ইন্দোনেশিয়া থেকে সামনের দিকে যত দেশ আছে যেমন মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর সবই কিন্তু এই স্যাটেলাইটের আওতায় থাকবে। এই স্যাটেলাইটের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জনবল নিয়োগ দেওয়া হবে, যার ফলে অনেক বেকার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের কেইউ ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডারের স্পট বিমের আওতায় বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরের জলসীমা। অন্যদিকে এই ব্যান্ড ট্রান্সপান্ডারের রিজিওনাল বিমের আওতায় রয়েছে ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়া।
রিজিওনাল টিসি ব্যান্ড বিমের আওতায় থাকা দেশগুলো হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ।
ফলে এসব দেশে টেলিযোগাযোগ ও সম্প্রচার সেবা দিতে পারবে বঙ্গবন্ধু-১। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিজিটাল বৈষম্য দূর হবে বলে আশা করা যায়।
ডাইরেক্ট টু হোম পদ্ধতিতে স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলেও সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচার করা সম্ভব হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন দুর্যোগে দেশের বিভিন্ন টেরিস্ট্রিয়াল অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যোগযোগব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ব্যবহার করা যাবে।
সাবমেরিনে কাজ কোনো কারণে ব্যাহত হলে তখন বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট সেবা পাবে। সন্দ্বীপ ও হাতিয়া দ্বীপের সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঢাকার সাথে ল্যান্ড কমিউনিকেশন বন্ধ হয়ে গেলে এর সাহায্যে ঢাকার সাথে যোগাযোগ করা যাবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ : বাংলাদেশের মালিকানাধীন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১
বাংলাদেশের প্রথম ভূমির (Geostationary) যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ । এর মধ্যে দিয়ে ৫৭ তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ । এটি ১১ ই মে ২০১৮ যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় । এটি ছিল ফ্যালকন ৯ ব্লক -৫ রকেটের প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ । এটি ফ্রান্সের থেলিস অ্যালেনিয়া স্পেস কর্তৃক নকশা ও তৈরি করা হয়েছে । বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -১ , ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৪০ টি কে – ইউ এবং সি – ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার বহন করছে এবং এর আয়ু ১৫ বছর । এর নির্মাণ ব্যয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা । বর্তমানে স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথ ও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে ইন্টারনেট বঞ্চিত অঞ্চল যেমন পার্বত্য ও হাওড় এলাকায় ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সেবা . টেলিমেডিসিন ও দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রসারেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে । টিভি চ্যানেলগুলো তাদের সম্প্রচার সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য বিদেশি নির্ভরতা কমিয়ে এর উপর নির্ভর করছে । ফলে দেশের টাকা দেশেই থাকছে । বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক অচল হয়ে পড়লে এর মাধ্যমে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ চালু রাখা সম্ভব । শুধু তাই নয় শেখ হাসিনা সরকারের বর্তমান মেয়াদেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট -২ মহাকাশে উৎক্ষেপণেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে । বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৪ ই জুন বেতবুনিয়ায় ভূ – উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন , সেই স্বপ্ন মহীরূহে পরিণত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । স্যাটেলাইটের বাইরের অংশে বাংলাদেশের লাল – সবুজ পতাকার রঙের নকশার উপর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু -১ , বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে ।
পরিশেষে বলা যায়, বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। যার ফলে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ আবিষ্কার ও উৎক্ষেপণ করা সম্ভব হয়েছে।
এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মহাকাশ যুগে প্রবেশ করেছে। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে এখন দেশের অভ্যন্তরে সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থা সচল থাকবে। এ ছাড়া দেশের অর্থনীতিও ত্বরান্বিত হবে। মোটকথা, বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতি সাধিত হবে।
তাহলে বন্ধুরা, স্যাটেলাইট কি বা স্যাটেলাইট কাকে বলে এ বিষয়ে আশা করি আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনারা জানতে পেরেছেন।
যদি আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করবেন। আর আর্টিকেলের সাথে জড়িত কোন প্রশ্ন বা পরামর্শ থাকলে অবশ্যই নিচে কমেন্ট করে জানিয়ে দিবেন।
অবশ্যই পড়ুন –